০
১৪৭৮ বার পঠিত
আমাদের দেশে দ্রুতই সব ‘অফ-টপিক’ হয়ে যায়। এখন অনেক ‘অন’ তথা চালু টপিকের আড়ালে হারিয়ে গেছে দুই কৃষকের আত্মহননের কথা। কৃষি নির্ভর দেশে কৃষকরা যখন আত্মহত্যা করে তখন বোঝা যায় সমস্যা ক্রমেই সমাধানহীনতার দিকে এগিয়ে চলেছে। আর সেই যাত্রাটাকে তরান্বিত করছে এই ‘অফ’ আর ‘অন’ টপিকের খেলা। প্রয়োজনীয় একটা বিষয়কে অপ্রয়োজনীয় কোনো বিতর্কে ঢেকে দেয়ার কূটকৌশল। যা আপাত নিরাময় মনে হলেও পরবর্তীতে তা আত্মঘাতী। শ্রীলঙ্কা যার জ্বলন্ত প্রমাণ। লঙ্কা পুড়ছে এখন হনুমানের লেজের আগুনে।
রাজশাহীতে সেচের পানি না পেয়ে দু’জন মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। এনজিও থেকে ঋণ এবং জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষ করতে চেয়েছিলেন ওই দু’জন। কিন্তু না পেরে কীটনাশক পান করেন তারা। এ দুজনকে কেউ আদিবাসী, কেউ উপজাতি, কেউ নৃগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করছেন। আমি এই জাতিতত্ত্বকে বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে এসেছি, এখনও করছি। মৃত রবি মারান্ডি আর অভিনাথ মারান্ডির একটিই পরিচয় তারা মানুষ এবং নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশ নামে পরিচিত রাষ্ট্রের বাসিন্দা। যে রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিলো বৈষম্যের বিরোধীতায় প্রতিটি নাগরিকের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করার জন্য। নিরাপদ শব্দটির অর্থ এখানে সার্বিক, মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা। সে অর্থে রাষ্ট্রব্যবস্থা রবি ও অভিনাথ ও তাদের শ্রেণিগত ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।
মূলত রাষ্ট্র ব্যর্থ হয় না, ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি যে ব্যবস্থায় চালিত তার অনেক সফলতা রয়েছে। উন্নয়ন রয়েছে। কিন্তু সে উন্নয়নের বিপরীতে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি হয়েছে, তাতে উন্নয়নের সুফল যাচ্ছে হতোগোনা কিছু মানুষের কাছে। বিপরীতে রবি ও অভিনাথ মারান্ডির মতন মানুষের শ্রেণিটা আরো বেশি অবহেলিত হচ্ছে। আরো বেশি কঠিন হয়ে উঠছে তাদের জীবনযাপন।
বৈষম্যের কথা যদি বলি। তবে উন্নয়নের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির সাথে রবি-অভিনাথের শ্রেণির পার্থক্য শতগুনের বেশি। ২০১৯ এ প্রথম আলো’র খবরের শিরোনাম ছিলো, ‘সবচেয়ে গরিবের চেয়ে সবচেয়ে ধনীর আয় ১১৯ গুন’। বৈষম্যের এই চিত্রটা সরকারি পরিসংখ্যান বিউরো’র। সুতরাং বৈষম্যটা এ থেকেই আন্দাজ করা যায়, আর বেসরকারি হিসেব চিন্তা করলে আসমান-পাতাল অবস্থা। সরকারি ভাবেই বলা হয়েছে, দেশের পাঁচ শতাংশ পরিবারের আয় মাসে মাত্র ৭৪৬ টাকা। চিন্তা করা যায়। ২০১৯ এ সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ীই এই ব্যবধান ক্রমবর্ধমান অর্থাৎ বাড়ছে।
২০১৯ সালেই বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন বলেছিলেন একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথা। যে শ্রেণিটির বিকাশ ঘটেছে ভোগ প্রবণতায়। এর সত্যতা আমরা চারিদিকে চোখ মেললেই দেখি। একটা শ্রেণি এদেশে হঠাৎ করেই ধনী হয়ে উঠেছে, উঠছে। রাস্তায় বেরুলেই ঝা চকচকে গাড়ির দেখা মেলে। যেসব গাড়ির দাম অর্ধকোটি থেকে দেড়কোটি টাকার মধ্যে। আর এর উপরের যে উচ্চবিত্ত শ্রেণি তাদের গাড়ির মূল্য দেড়কোটি থেকে ৫কোটি। এ থেকেও হঠাৎ ধনী হওয়া ভোগবাদি শ্রেণি এবং ধনী থেকে আরো ধনী হওয়া শ্রেনিদ্বয়ের উপার্জনের একটি রেখাচিত্র পাওয়া সম্ভব।
বিনায়ক সেন অবশ্য স্বীকার করেছেন সেই সময়ের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করে তা মানবসম্পদ উন্নয়নে ও দরিদ্র মানুষের কল্যাণে সঠিক পুনর্বন্টন করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু মানবসম্পদ তথা দরিদ্র মানুষের উন্নয়ন হয়নি।
২০১৮ সালে অক্টোবরে বিশ্বব্যাংকের ‘প্রভার্টি অ্যান্ড শেয়ার প্রসপারিটি’ বিষয়ক প্রতিবেদনও সে কথাই বলে। মধ্যম বা উন্নয়নশীল যাই বলি না কেন, সে প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ হতদরিদ্র অবস্থার মধ্যে রয়েছে। খেয়াল করুন শব্দটি কিন্তু হতদরিদ্র, শুধু দরিদ্র নয়। তাহলে দরিদ্র রয়েছে কী পরিমান। অর্থাৎ কথা একটাই উন্নয়নের যে কথা হয় তার সুফল পেয়েছে হঠাৎ ধনী হওয়া একটা শ্রেণি।
এই যে হঠাৎ সৃষ্ট ধনিক শ্রেণি এবং তাদের প্রাপ্ত সুফলের প্রমাণ পাওয়া যায় ‘ওয়েলথ-এক্স’ এর প্রতিবেদনে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির কাজ হলো বৈশ্বিক সম্পদ নিয়ে। ২০১৮তে খোদ এই প্রতিষ্ঠানটি বিস্মিত হয় বাংলাদেশে অতিধনীর দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধিতে। বিশ্বের বড় অর্থনীতির ৭৫টি দেশকে পেছনে ফেলে দেয় বাংলাদেশের অতিধনীরা। এমনকি এক নম্বর চীনকেও পেছনে ফেলে দেয় বাংলাদেশ। চীন চলে যায় দ্বিতীয় নম্বরে। কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশের ধনীদের চেয়ে বৃদ্ধির হারের শতাংশ হিসেবে অনেক পেছনে চীন। বাংলাদেশের ধনীদের বৃদ্ধির হার ১৭.৩ আর চীনের ১৩.৭। ধনী বৃদ্ধির হার হিসেবে কেউ যদি বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান এর মতন দেশের থেকে এগিয়ে রাখতে চায় তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু বেঠিক ঘটে যখন ধনী দরিদ্রদের বৈষম্য বিষয়ে অঙ্ক কষা যায়। তখন এই আসমান-জমিন নয়, আসমান-পাতালের বিভেদটা সামনে এসে যায়। প্রদীপের সামান্য আলোর নিচের বিশালতা যে অন্ধকারপূর্ণ তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
আবার পরিসংখ্যান বিউরো’র আলাপে যাই। ২০১৬ সালে তারা জানালো দেশের সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ শতাংশ। চিন্তা করা যায়! এমন বৃদ্ধি কি আদৌ কোনো বৈধ পথে সম্ভব? গরীবদের ক্ষেত্রে এর উল্টো চিত্র দিয়েছে পরিসংখ্যান বিউরোই। সেখানে দেখা গেছে সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ পরিবারের আয় একই সময়ে কমেছে ৫৯ শতাংশ। অর্থাৎ গরীবের যে পরিমান কমেছে প্রায় সেই পরিমানই বেড়েছে ধনীদের। তাহলে সোজা কথায় কী দাঁড়ালো গরীব মারা ধনী। অর্থাৎ রাষ্ট্র ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে এই গরীবদের আয় থেকে হঠাৎ ধনী শ্রেণির লুটে নেয়ার আগ্রাসী তৎপরতা থামাতে। আর এই তৎপরতার শিকারই রবি ও অভিনাথ মারান্ডিরা।
আমার জেলা শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে রবি ও অভিনাথের আত্মহননের আগে শফি উদ্দিন নামে এক কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সেই একই কাহিনী। ঋণ নিয়ে জমি চাষ করতে গিয়ে সেচ পায়নি। উল্টো সেচ চাওয়ার অপরাধে স্থানীয় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের দ্বারা নিপীড়িত হতে হয়েছে সেই কৃষককে। সেই কষ্টে শফি উদ্দিন আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। এজন্যই আমি জাতিতত্ত্বের একটি তত্ত্বই মানি, সেটা হলো মানুষ তত্ত্ব। আমার কাছে শফি উদ্দিন যা রবি ও অভিনাথও তা। সারাদেশের নিপীড়িতরাই শফি উদ্দিন , রবি বা অভিনাথ।
শেষ কথা হলো, একটা দেশের উন্নয়ন তখনই সার্থক হয় যখন ধনী গরীবের বৈষম্য উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে আসে। যখন নিম্ন আয়ের একজন মানুষ নিশ্চিত জীবনযাপন করতে পারেন। জার্মানির বার্লিনে আকাশছোঁয়া স্কাইস্ক্র্যাপার নেই, কিন্তু সেখানে ধনী গরীবের বৈষম্যও সেভাবে নেই। সেখানে মানুষের জীবন নিশ্চিত। শিক্ষা শেষে চাকুরি, অসুস্থতায় চিকিৎসা সব দোরগোড়ায়। বিপরীতে আমাদের অবস্থা কী। শিক্ষা শেষে চাকুরির কোনো নিশ্চয়তা নেই। অসুস্থতায় সঠিক চিকিৎসা এখনও দিল্লি দূরঅস্ত, করোনাকাল যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সুতরাং উন্নয়নের মূল সংজ্ঞা হলো মানুষের যাপিত জীবন নির্বিঘ্ন করা। শফি উদ্দিন , রবি ও অভিনাথরা যাতে আত্মহনেরর পথ বেছে না নেয়। এর বাইরে উড়াল সেতু, স্কাইস্ক্র্যাপার, মেট্রো রেল, পাতাল টানেল আর যা কিছু তার সবই অর্থহীন।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন