০
১৭১০ বার পঠিত
বিশাল সমুদ্রে বসবাসকারী ছোট মাছেরা চিরকালই অন্য মাছেদের তুলনায় একটু পিছিয়ে পড়া। জেলেদের জাল তাদের পাশ কাটিয়ে যায় স্বাচ্ছন্দ্যে, কিন্ত বড় মাছদের ভুঁড়িভোজের জোগাড় সেই ছোট মাছকেই হতে হয় শেষ অবধি। মানুষের পাতে পড়া থেকে বাঁচল, কিন্ত পড়বি পড় রাঘব বোয়ালের পেটে। বাংলাদেশেরও খানিকটা যেন এই এক অবস্থা। কোনমতে আমেরিকা-চীনের হাত থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করা হল কি হল না, ভারতবর্ষ ওমনি দু’হাত বাড়িয়ে নিত্য নতুন শ্বাসরোধ করবার প্রক্রিয়া নিয়ে হাজির দোরগোড়ায়। এরই নাম খাতায়-কলমে বন্ধুত্ব (আড়ালে যাকে আমরা কর্তৃত্বও বলে থাকি), বা সাহায্য (ধরে নিচ্ছি বেগার খাটানো নয়)।
বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনোভাবের সমস্যা সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই বুঝতে হবে। একথা সত্য, তৎকালীন ভারত সরকার যদি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর পাশে সামরিক সাহায্য নিয়ে না যেত, পাকিস্তানী সেনার বীভৎসতার অন্ত নিশ্চিত করা সম্ভব নাও হতে পারত। কিন্ত এই সাহায্যের পেছনেও রয়েছে হালকা চালাকি। ভারতের এই সিদ্ধান্তের পেছনে যতটা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শের প্রতি সহমর্মীতা, তার চেয়েও কয়েক গুণ বেশী দায়বদ্ধতা ছিল ইন্দিরা গান্ধীর বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার প্রতি। যেভাবে শরনার্থীদের চাপে পশ্চিমবঙ্গ তথা অন্যান্য পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছিল, ভারতের পক্ষে আর তার চিরকালীন ‘ধরি-মাছ, না-ছুঁই-পানি’ মনোভাব চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। মজার বিষয় এটাই, ভারতীয় রাজনীতিবিদদের একটি বিশাল অংশ যখনই ১৯৭১ প্রসঙ্গে আসেন, প্রায়ই ভারতের নিজস্ব পারিপার্শ্বিকতাকে ভুলে গিয়ে ইন্দিরাকে শুধুমাত্র ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল এর কাছাকাছি কোন অতিমানবীরূপে উপস্থাপন করে থাকতে পছন্দ করেন। আর এই চিন্তারই বহমানতা আমরা দেখতে পাই ভারতবর্ষের বাংলাদেশ-সহ নেপাল, ভুটান এমনকি শ্রীলঙ্কার প্রতি চরম বৈষম্যে। মুখে কথা যতই বলুক সার্ক-স্থাপনের, ভেতর ভেতর ‘বিগ ব্রাদার’ স্বভাবের ছাপ বাইরেও এসে পড়েই বৈকি।
এই যেমন ধরুন হালের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এতদিন নিজেদের দেশের মাটিতে মার্কিন-ইউরোপীয় কোম্পানিদের যথেচ্ছ নৃত্য করতে দিয়েছে ভারত, এবং আমরা আশা রাখতে পারি যে আগামীতেও তা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। কোকাকোলা হোক বা কয়লা- প্রতিটি ক্ষেত্রেই নগ্নরূপে প্রকাশ পেয়েছে ভারতবর্ষের মাটি-মানুষের ওপর রাষ্ট্রের নিজস্ব সার্বভৌমত্ব। একের পর এক ফ্যাক্টরি গড়া হয়েছে দেশের গ্রাম-নদী-বন-জঙ্গল ধ্বংস করে। প্রকৃতি হাঁসফাঁস করে উঠছে প্রতিদিন সেইসব ফ্যাক্টরি থেকে নিঃসৃত কালো ধোঁয়া-জলের মাসুল গুনতে গুনতে। আর আমরা বড় বড় মঞ্চে নিজেদের পিঠ চাপড়াচ্ছি শিল্পায়ন, বিদেশি লগ্নি আর উন্নয়নের স্লোগান তুলে। রাষ্ট্রসীমার ভেতর দাপিয়ে বেড়াতে বেড়াতে অতিষ্ঠ ভারত এখন তাই সীমার বাইরে ডানা মেলতে চায়। খুব বেশীদূর যেতে হয়নি তাকে। বাংলাদেশের সুন্দরবনেই পেয়ে গেছে সেই (অন)অধিকার চর্চাক্ষেত্র। পরিবেশবিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা সম্পূর্ণ রূপে উপেক্ষা করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আর দুই দেশের শিক্ষিত সমাজের অংশবিশেষ শুধুই দ্বিপাক্ষিক বন্ধুতার ঢং দেখতে ও দেখাতে চাইছে এখানে।
ভারত-বাংলাদেশের এই প্রজাতির চুক্তিগুলি নিয়ে ভাবতে বসলেই কেন জানিনা অগাস্ট মাসের রাখি বন্ধন মনে পড়ে। মূলত অবাঙালি সমাজের এই উৎসব ভারতে সর্বত্র পরিচিত ‘রক্ষা বন্ধন’ নামে। এইদিন বোনেরা ভাইদের কবজিতে ‘রাখী’ পরিয়ে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ভাইয়েদের হাতে তুলে দেয়। এক একটা এমন চুক্তি হয়, আর ইন্ডিয়ার কবজিতে রাখীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বেচারি বোন বুঝতেও পারেনা, এই ধরনের বন্ধনের আসল উদ্দেশ্য গন্ডী টেনে দেওয়া। মনে করিয়ে দেওয়া কে সুরক্ষা প্রদান করার ক্ষমতা রাখে, আর কে ইতিহাসের ফেরে অরক্ষিত, দুর্বল। পুরুষতন্ত্রই হোক বা রাজতন্ত্র- সার্বভৌমত্বের অভাব সর্বক্ষেত্রেই গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে।
আসলে আমাদের মূল সমস্যা, আমরা রাষ্ট্র আর দেশ এক করে ফেলি মাথার ভেতর। মোদী-শরিফের হাসি দেখে ভাবি দুই কোক স্টুডিয়োয় মিল হল বুঝি। আর যেই একটা করে গুলাম আলি জন্ম নেন, কন্ঠে ধরেন শান্তির বাণী, ঠিক তখনই রাষ্ট্র বন্দুক উঁচিয়ে লেগে যায় নিজ নিজ অঙ্গের স্বাতন্ত্র বজায় রাখতে। ফলস্বরূপ মিথ্যে হাসির পেছনে তিলে তিলে মরে যায় মুক্তিপ্রার্থী দুটি দেশ। দুটি মানুষের সমষ্টি। আর এভাবেই কবীরের সাথে ফৈজ আহমেদ ফৈজ অপরিচিত থেকে যান আজীবন। বাংলাদেশের সাথেও সমস্যা এটাই। ঢাকার ক্যাফেতে ঘটে যাওয়া জঙ্গী আক্রমণে হারানো প্রাণের তালিকায় হিন্দু নামটিকে খুঁজে পেতে দুবার ভাবতে হয়না ভারত রাষ্ট্রকে। বুঝতে পারি, মানুষের মৃত্যু কোন রাষ্ট্রকে আর বিচলিত করতে পারেনা। এজেন্ডার মৃত্যুকেই বরং তুলনায় ভয় পায় রাষ্ট্র অনেক বেশী। মানুষ মরলে রাষ্ট্রের কিছুই এসে যায় না। কিন্ত এক একটা দেশ হেরে যেতে থাকে প্রতিনিয়ত। আর হেরে যাওয়া দেশ, হারিয়ে যাওয়া মানুষের সমষ্টির ওপর ভিত্তি করেই জন্ম নেয় এযুগের সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র।
এটাই রাজনীতি। রাজার নীতি।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন