০
৫৫২ বার পঠিত
বাংলাদেশে যে কোন সামাজিক উত্তরণের পেছনে প্রধান বাধা “রায়কা বাচ্চা রায়” আর “খানকা বাচ্চা খান” রাজনৈতিক শিবির।
রায়কা বাচ্চা রায় হচ্ছে জমিদারি হারানো হিন্দুত্ববাদী মানস। খানকা বাচ্চা খান হচ্ছে জমিদারি হারানো ইসলামপন্থী মানস। এ আলোচনায় এটা অবশ্য উল্লেখ্য যে; সব জমিদারকে খলনায়ক হিসেবে চিত্রিত করা অনুচিত। বাংলাদেশে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান গড়া-পুকুর সংস্কার-পথ-ঘাট সংস্কার, দাতব্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মতো অনেক সুকৃতি রয়েছে তাদের।
কিন্তু যখনই রায়কা বাচ্চা রায়; হিন্দু শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরে রেডিও হিন্দুস্তান শোনে; তখন ভারত রাষ্ট্রের অপচ্ছায়া আমাদের ছোট্ট সবুজ বদ্বীপের মৌলিকত্বকে ক্ষুণ্ণ করে। আবার খানকা বাচ্চা
খান মুসলিম শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরে যখন রেডিও পাকিস্তান শোনে; তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অপচ্ছায়া আমাদের ছোট্ট শ্যামল গ্রামের স্বকীয়তাকে বিপন্ন করে।
এই “রায় কা বাচ্চা রায়” ও “খান কা বাচ্চা খান” অনেক আদিম এক সুপিরিওরিটির ভ্রান্তির প্রেতায়িত আত্মা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মান শ্রেষ্ঠত্বের ভুল চিন্তার অনিবার্য ফলাফল আমরা দেখেছি। দার্শনিক নিটশে কিংবা বার্টান্ড রাসেল “ম্যান এন্ড সুপারম্যান” দর্শন চর্চা করেছিলেন; মানুষের উতকৃষ্ট মানুষ হয়ে ওঠার; আত্মকেন্দ্রিক ম্যান থেকে পরার্থে সুপারম্যান হয়ে ওঠার স্বপ্ন জারিত করতে। কিন্তু আডলফ হিটলার ছিলেন অত্যন্ত দুর্বল ছাত্র; শৈশবের হতাশা, আর্ট স্কুলে ভালো করতে না পেরে “উগ্রজাতীয়তাবাদের দোকান” খোলাকেই তার ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারের জন্য ভালো মনে করেছিলেন।
সেই অত্যন্ত খারাপ ছাত্র হিটলার নিটশে কিংবা বার্টান্ড রাসেল পড়ে “সুপারম্যান” শব্দটিকে আক্ষরিক অর্থে নেন। তারপর বয়ান দেন, মানবজাতি যদি ম্যান হয়; জার্মানরা তবে সুপারম্যান।
অমনি উগ্র নাতসি জাতীয়তাবাদের দোকানে জার্মান আশার সওদাগর বালিশ ও কাছিমরা হাজির হয়ে যান, জার্মানদের “সুপারম্যানের স্বপ্নে”র কারবার করে বাইশ ও বাইশশো ধনাঢ্য পরিবার গড়ে তোলার ভিশন ১৯৪১-এ ঝান্ডা উপরে তুলে ধরে। এই সুপিরিওরিটির চেতনার দোকানে, নিখুঁত জার্মানের কষ্টকল্পনার কারণ থেকে জার্মান সমাজে ধারণা হয়েছিলো, জার্মান সুপারম্যানের ঘরে কখনো প্রতিবন্ধী শিশু জন্মাতে পারে না। এই কারণে নাতসি জমানার জার্মান পরিবারে প্রতিবন্ধী শিশু জন্মালে তাকে হত্যা করা হতো; যাতে সুপিরিওরিটির বোগাস বয়ান ধরা পড়ে না যায়। এমনকী হিটলার কিংবা গোয়েবলসের চোখে সুন্দরী জার্মান তরুণীদের গর্ভ ভাড়া করা হতো হিটলারের চোখে মেধাবী নাতসি সুপুরুষদের মাধ্যমে তাদের কাল্পনিক “সুপারম্যান” জন্ম দিতে। এই শিশুদের বাবা-মা কেউ নয়, জার্মান উগ্রজাতীয়তাবাদই এককোষী এমিবার মতো এদের বাবা-মা ছিলো।
সেই বিকৃত চিন্তার উদগ্র উগ্র জাতীয়তাবাদের আস্ফালন দক্ষিণ এশিয়াকে অত্যন্ত আকর্ষণ করেছিলো। বর্ণবাদি দক্ষিণ এশিয়ায় “রায় কা বাচ্চা রায়” আর “খানকা বাচ্চা খানে”রা শাসকগোষ্ঠীর বালিশ আর কাছিম হয়ে গড়ে তুলেছিলো জমিদারি। সেই জমিদারির নেশাটাই উগ্রজাতীয়তাবাদের নেশা হয়ে নানারকম চেতনার “সুচিন্তা ভবন” আর “কান্দন ভবন” গড়ে তুলেছে।
বলে রাখা প্রয়োজন; প্রাচীন দক্ষিণ এশিয়া প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ছিলো। অভিবাসন বা মাইগ্রেশান যেহেতু প্রকৃতিরই নিয়ম; সাইবেরিয়ার পাখি যেমন বাংলাদেশে আসে; সাইবেরিয়ার মানুষও বাংলাদেশে এসেছিলো। সেটা স্বাভাবিক প্রকৃতির নিয়মে।
আফ্রিকা-ইরান-ইরাক-আরব বিশ্ব-তুর্কেমেনিস্তান-উজবেকিস্তান-আজারবাইজান-মঙ্গোলিয়া-চিন এরকম নানা অঞ্চল থেকে চার ধাপে বিপুল সংখ্যক মানুষ দক্ষিণ এশিয়ায় আসে। এদের মধ্যে যাদের গাত্রবর্ণ গৌর তারা নিজেদের “রায়কা বাচ্চা রায়” কিংবা “খানকা বাচ্চা খান” ভেবে সেই যে নাতসি উতকৃষ্টতার ভ্রান্তি; সেটা চর্চা করে সারাজীবন। আর যাদের গাত্রবর্ণ কালো তারা বর্ণবাদ সহ্য করতে করতে একসময় ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, আমি ভূমিপূত্র; যদিও সে হয়তো আফ্রিকা থেকে অভিবাসী মানুষ।
ফলে এটা সুস্পষ্ট যে, দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেকে উতকৃষ্ট বা ভূমিপুত্র কোন কিছু ভাবারই সুযোগ নেই। পৃথিবীর যে এলাকায় যখন সমৃদ্ধি থাকে; তখন নানা-অঞ্চলের মানুষ সেখানে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। একসময় ইউনাইটেড সাউথ এশিয়া (ইউএস এ) তেমন ছিলো; কিছুকাল আগে ইউনাইটেড স্টেটস অফ এমেরিকা (ইউএসএ) যেমন মাইগ্রেশনের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিলো।
কিন্তু রায়কা বাচ্চা রায় আর খান কা বাচ্চা খান লালন কিংবা হাসনরাজার গান শুনে “সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই”-এই সহজ বিষয়টি বুঝে না বুঝে নিজের উগ্র শ্রেষ্ঠত্ববাদের ঝান্ডা তুলে ধরতে হিন্দু ধর্ম আর ইসলাম ধর্মের দোকানদারি করে। রায় কা বাচ্চা দিল্লীর কাল্পনিক হিন্দুত্ববাদী শ্রেষ্ঠত্বের স্বপ্নের জাল বুনে বাংলাদেশের মানবিক কোমল পললে। খান কা বাচ্চা খান ইসলামাবাদের কাল্পনিক ইসলামপন্থী শ্রেষ্ঠত্বের জাল বুনে বাংলাদেশের নদী ধোয়া সমতলে।
রায়কা কা বাচ্চা রায় যেহেতু শুধু রেডিও হিন্দুস্তান শুনে ফলে সে শ্রেষ্ঠ হিন্দু- বাতাবি লেবুর চাষের রূপকথার গল্প জেনে আকুল হয় হিন্দু-মুল্লুকের জন্য। খানকা বাচ্চা খান যেহেতু শুধু রেডিও পাকিস্তান শোনে ফলে সে শ্রেষ্ঠ মুসলিম -বাতাবি লেবুর চাষের রূপকথার গল্প জেনে আকুল হয় মুসলিম মুল্লুকের জন্য।
এই আউটডেটেড রায় কা বাচ্চা রায়, যে তার অসভ্য মানবসম্পদ বলয় চুলকাতে চুলকাতে অসভ্য পাকিস্তানকে দুটি গালি দিয়ে জেনেটিক সুপিরিওরিটির ঠাকুরমার ঝুলিকে তৃপ্ত করে; সে যদি শুধু রেডিও হিন্দুস্তান শোনা দুটি দিন বাদ দিয়ে পাকিস্তানের ডন পত্রিকা আর জিও টিভি দেখে; তাহলে সে জানতে পারবে; পাকিস্তানে গত তিনটি সাধারণ নির্বাচনে ইসলাম ধর্ম ভিত্তিক দল জামাত তার জামানত হারিয়েছে।
এই আউটডেটেড খান কা বাচ্চা খান যে তার অসভ্য মানবসম্পদ বলয় চুলকাতে চুলকাতে অসভ্য হিন্দুস্তানকে দুটি গালি দিয়ে জেনেটিক সুপিরিওরিটির খোয়াবনামাকে তৃপ্ত করে; রেডিও পাকিস্তানের মোহ দুটি দিন দূরে রেখে সে যদি শুধু যদি ভারতের এনডিটিভি-আনন্দবাজার পত্রিকা অনুসরণ করে; সে বুঝবে হিন্দুত্ববাদের এই আদিম উত্থানের কালেও কলকাতা ও নতুন দিল্লীতে হিন্দু ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল বিজেপি সমর্থন পায়নি।
রায়কা বাচ্চা রায় আর খান কা বাচ্চা খানের ভারসাম্য রেখে চোরের খনিতে যে চাটার লীগ আছে আর খান কা বাচ্চা খানদের নিয়ে একটি-দুটি রায় কা বাচ্চা রেখে চোরের খনিতে যে চাটার দল আছে; এরা দেশের সম্পদ লুন্ঠন করে চাটার লীগ ও চাটার দলের বেয়াইয়েরা চাটার বিমানে উড়ে যাওয়ার প্রয়োজনে; পাকিস্তান আর হিন্দুস্তানের কাকতাড়ুয়া বানিয়ে গত অর্ধশতক চালিয়ে গেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের অপরাধ-মানসের তান্ডব। বাংলাদেশের অপরাধ অস্বীকারের এই রায় ও খানের বুলিবুলি আখড়াইয়ে; বাংলাদেশ সমাজ অনেক প্রচেষ্টা থাকার পরেও আজ নৈরাশ্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত।
উল্লেখ্য যে ভারত ও পাকিস্তানে বাংলাদেশের আতিথেয়তা, গান-কবিতা-ভাষা আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধ-সামাজিক বন্ধন-পরিশ্রমী মানুষ আর আত্ম নির্ভর উন্নয়ন কৌশল অর্জনের সাফল্যের আলোচনাই প্রাধান্য পায়। জামায়াতের চিপায় কিংবা বিজেপির চাপায় কিছু বাংলাদেশ বিরোধী কথা কপচানোর হ্যাং ওভার থাকলেও; আজকের দিনে তা অপ্রাসঙ্গিক।
বাংলাদেশের একমাত্র ঘাটতি আত্মসমালোচনায়; নিজের সমাজে বর্ণবাদ-খুন-লুন্ঠন-মানবতাবিরোধী অপরাধ লুকিয়ে রেখে টকশো আর ফেসবুক ভাঁড় দিয়ে স্বদেশীর থাবায় স্বদেশীর গণহত্যাকে অস্বীকার। যে কারণে আজ আত্মঘাতি বাংলাদেশ; “আপনা মাষে হরিণা বৈরী।”
ঘাড় গুঁজে জাস্টিফিকেশান দেবার এই হীন চাটার মানুষগুলোকে সভ্যতার আলোয় নিয়ে আসতে হবে। অপরাধী নয়; আমাদের মনোযোগ দিতে হবে অপরাধ বিনাশে। এশিয়ার বৃহত্তম কারাগার নয়; এশিয়ার বৃহত্তম সংশোধনী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে কারাগার হীন কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তোলা।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন