বাংলায় খুব জনপ্রিয় একটি প্রবাদ-প্রবচন আছে- ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি‘। আমার মনে হয় এই প্রবাদ-প্রবচনটি একটু আপডেট করার প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশে এই প্রবচনটি হবে- ‘মায়ের চেয়ে মাসির প্রতি দরদ বেশি‘।
কারণটা একটু বুঝিয়ে বলি।
বাংলাদেশ যদি মা হয় তাহলে তার প্রতি যেটুকু ভালোবাসা দেখানো প্রয়োজন, দায়িত্ব কর্তব্যবোধ দেখানো দরকার, সেটা মোটেই না করে- আমরা অন্য দেশের ইস্যু নিয়ে অনেক বেশি আবেগ আক্রান্ত হয়ে পড়ি। নিজের ঘরের সন্তান মানুষ করতে পারি আর না পারি, রাতে বিছানায় শুয়ে বউয়ের সাথে পাশের বাসার বেয়াদব ছেলেটার বাবা-মায়ের খুব সমালচনা করতে পারি। নিজের ঘর নোংরা রেখে মানুষের ঘরে কত গন্ধ এটা খুঁজে পেতে আমাদের কোনও জুড়ি নেই। ‘চালুনি কয় সুইরে- তোর পাছা ফুঁটা’! আমাদের অবস্থা হয়েছে তেমন।
নিজের দেশের সমস্যার অন্ত নাই, কিন্তু পাশের দেশের মানুষের জন্য আমরা হায় রোহিঙ্গা! হায় রোহিঙ্গা! করছি।
অনলাইনে ঢুকলেই মনে হবে এর চেয়ে বড় ক্রাইসিস এই মুহুর্তে আমাদের দেশে আর নেই। আমাদের উচিত সব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা। আমরা শুধু জানি- তারা মুসলিম। তারা নির্যাতিত। তাদেরকে অমানবিক ভাবে হত্যা করা হচ্ছে! মায়ানমার সরকার তাদেরকে মায়ানমারের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করেছে। ব্যাস। আর যায় কোথায়? কী! মুসলমান নির্যাতিত! এইবার হিন্দুরে ধর… বৌদ্ধরে মার রে…
আমাদের দেশের অনেকেই দেখছি রোহিঙ্গাদেরকে এক্ষুণি বাংলাদেশে পুনর্বাসনের পক্ষে কথা বলছেন। সীমান্ত খুলে দিতে বলছেন। ভালো কথা। বলতেই পারেন। সবার যার যার মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। এখন একটু দেখি ঘটনাটা কী? যা শুনছি বিষয়টি কী এতই সরলীকরণ? নাকী আরও কিছু আছে?
আমি মানুষ হত্যার পক্ষে নই। অত্যাচারের পক্ষেও নই। কিন্তু যা শুনছি যা জানছি বিষয়টিকে ঠিক সেভাবেই চোখ বন্ধ করে অন্ধের মতো একটা স্ট্যান্ড নেবার পক্ষেও আমি নই। আমাকে অবশ্যই সত্য জানতে হবে। এবং সেটা বৃহৎ পরিসরে। সমগ্রকে বাদ দিয়ে আংশিক অবস্থান সবসময় একপেশে অবস্থান। আমি যেহেতু এই দেশেরই একজন নাগরিক, তাই আমার অবস্থান সকলকে জানানোর প্রয়োজনটা বোধ করছি।
আজকের এই বর্তমানে যে ঘটনা ঘটছে সেটা চলতি ইতিহাসের অংশ। কিন্তু এই চলতি ইতিহাস কী একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? না। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ইতিহাস একটি জালের মতো। বিশাল একটি জাল। সময় যাকে প্রতিনিয়ত বুনে যাচ্ছে। একটি মুহুর্ত একটি ঘটনাও এর বাইরে নয়। সবই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বর্তমানকে বুঝতে হলে আপনাকে এর থেকে বেরিয়ে এসে উপর থেকে দেখতে হবে। যেনো আপনি অনেকটা অতীত থেকে আজকের সময় পর্যন্ত দেখতে পান। তাহলেই বুঝতে পারবেন কেন- কী- কীভাবে ঘটছে।
সময় খ্রিস্টপূর্ব ৩০৪ অব্দ সম্রাট অশোকের জন্মকাল। আজ থেকে ২৩২০ বছর আগের কথা। তিনি তার শাসন আমলে বিশাল একটা সাম্রাজ্যকে তার নেতৃত্বের অধীনে নিয়ে আসেন। সম্রাট অশোকের সময়কার প্রাচীন ভারতের মানচিত্র ছিল এমন- পশ্চিমে আফগানিস্তান; পাকিস্তান, ভারতের নানা প্রদেশসহ পূবে বাংলাদেশ মায়ানমার; উত্তরে আসাম; দক্ষিণে কেরালা এবং অন্ধ্র প্রদেশ ছিল অশোকের বিশাল সাম্রাজ্যের সীমানা। এর মধ্যে আরো অনেক রাজ্য ছিল। তবে সবচে শক্তিশালী রাজ্য ছিল মগধ। মগধের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র (বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্য )। অশোকের রাজপ্রাসাদটি পাটলিপুত্র নগরীতে অবস্থিত ছিল। বৌদ্ধধর্মের প্রভূত পৃষ্ঠপোষকতা অশোকের সময়েই শুরু হয়। আমাদের এই বাংলা অঞ্চলটি মায়ানমারের কিছু অংশসহ গঙ্গারেড্ডি নামক একটি বিশাল অঞ্চল ছিল সেই সময়। টলেমির প্রাচীন মানচিত্রে আমরা সেটা দেখতে পাই। হিউয়েন সাং বলেছেন আমাদের এই মহাস্থানগড়ের কথা। আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির সংরক্ষিত প্যাপিরাস স্ক্রোলেও ছিল এই গংগারেড্ডির কথা। আলেজান্ডার দ্যা গ্রেট গংগারেড্ডির এই অঞ্চল আক্রমণ করতে ভয় পেয়েছিলেন।
কেন এত কথা বলছি? এত পুরানো কাসুন্দি ঘেটে কী লাভ? এর সাথে মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের কী সম্পর্ক? আছে সম্পর্ক আছে। পড়তে থাকুন পাঠক।
এই অঞ্চল এতোটাই সমৃদ্ধ ছিল যে- এর নাম পৃথিবীর দূর দূরান্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তৈরি করেছিল অসংখ্য মঠ, বিশ্ববিদ্যালয়। হ্যাঁ এই অঞ্চলেই প্রথম আবিস্কার হয় ‘শূন্যের’ অসীম তত্ত্বের। প্রাচীন ইজিপশিয়ান প্যাপিরাস স্ক্রোলেও এই অঞ্চলের আশ্চর্য জ্ঞানী মানুষের কথা আছে। তখন শত শত বছরে ভাগ্যান্নেষণে অনেক জাতি গোত্রের মানুষই এই অঞ্চলে এসেছিল।
অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের মধ্য দিয়ে আরাকানে মুসলমানদের বসবাস শুরু হয়। আরব বংশোদ্ভূত এই জনগোষ্ঠী মায়্যু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের (বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের নিকট) চেয়ে মধ্য আরাকানের নিকটবর্তী ম্রক-ইউ এবং কাইয়্যুকতাও শহরতলীতেই বসবাস করতে পছন্দ করতো। এই অঞ্চলের বসবাসরত মুসলিম জনপদই পরবর্তীকালে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে।
আমরা একটু ঘুরে আসি তার ৪০০ বছর পরে। যেমন একজন তুর্কি সেনাপতি।
তার নাম ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি। তিনি ১২০৫-৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে তৎকালীন বঙ্গের শাসক সেন রাজবংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে সেন গৌড় দখল করেন। লক্ষণ সেন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে তার শহর নদিয়া ছেড়ে তৎকালীন বঙ্গে চলে যান, এবং তার সৈন্যরা পরাজিত হয়ে শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
বখতিয়ার কী করেন?
তিনি নদিয়া শহরটিকে ধ্বংস করে দেন। মাত্র দু’হাজার সৈন্য সংগ্রহ করে পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজ্যগুলো আক্রমণ ও লুণ্ঠন করতে থাকেন। সেইসময়ে তার কথা চারিদিক ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং অনেক ভাগ্যান্বেষী মুসলিম সৈনিক তার বাহিনীতে যোগদান করতে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে তিনি একদিন এক প্রাচীরবেষ্টিত দূর্গের মতো স্থানে আসেন, এবং আক্রমণ করেন। প্রতিপক্ষ কোনো বাধাই দেয় নি।
দূর্গজয়ের পর তিনি দেখলেন যে দূর্গের অধিবাসীরা প্রত্যেকেই মুণ্ডিতমস্তক, এবং দূর্গটি বইপত্র দিয়ে ভরা। জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি জানতে পারলেন যে- তিনি একটি বৌদ্ধ বিহার জয় করেছেন। এটি ছিল ওদন্ত বিহার বা ওদন্তপুরী বিহার। সেইসময় থেকেই মুসলমানেরা জায়গাটিকে বিহার বা বিহার শরিফ নামে ডাকে।
১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি ধ্বংস করার জন্য খিলজিকে দায়ী করা হয়। সেখানে থাকা সকল ছাত্রদেরকেও সেসময় হত্যা করা হয়। পুরো বাংলা অঞ্চল থেকে বৌদ্ধদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। তারা পালিয় প্রাণে বাঁচতে পাহাড়ে জঙ্গলে চলে যায়। তাদের হাজার বছরের মাতৃভূমি তারা চিরতরে ফেলে চলে আসে। তারা সকলেই ছিল বৌদ্ধ- ভিক্ষু- জ্ঞানী।
এখন লক্ষ করলে দেখবেন পাঠক, বৌদ্ধদেরকে পাহাড়েই দেখতে পাওয়া যায় সমতলের চেয়ে। বৌদ্ধদের সব বিশ্ববিদ্যালয় মঠ ধ্বংস করে দেয় এই মুসলামান বীর। একবার ভাবুন পাঠক, বৌদ্ধরা সেই কথা কী ভুলে গেছে? না তারা সেটা ভোলেনি।
তাই ইতিহাস এটা জানায় যে, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের যে রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া সে রাজ্য দখল করার পর আবার বৌদ্ধদের সেখানে বসবাস শুরু হয়। তারা তাদের ২০০০ বছরের প্রাচীন মাটির কিছু অংশ ফেরত পায়।
মুসলিমরা এই অঞ্চলে বৌদ্ধদের কাছে বহিরাগত। যেমন বহিরাগত ছিল পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ব্রিটিশরা, ঠিক তেমনই মুসলমানরাও এই অঞ্চলে বহিরাগত। শুধু পার্থক্য হচ্ছে ওইসব জাতি ঠিকই একসময় নিজেরা নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছে, কিন্তু মুসলমানরা যায় নি। তারা এসেছে মাত্র ৮ম শতকে। আর বৌদ্ধরা বা সনাতন ধর্মের মানুষরা মায়ানমারে বাস করছে প্রায় ১৩ হাজার বছর যাবত। মুসলমানরা কেবল থেকে গিয়েই শান্ত হয়নি। তারা লুট করেছে, হত্যা করেছে বহু বৌদ্ধদের, হিন্দুদের। এদেরকে তাড়িয়ে দিয়েও তারা ক্ষান্ত হয়নি, যেসব হিন্দু বৌদ্ধ রয়ে গেছে – মাটি কামড়ে, তাদের কাছে তারা আরবের ভাষা, আইন এই অঞ্চলের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে বারবার। কিন্তু এই অঞ্চলে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও সেটা তারা তেমন করে পারেনি। কিন্তু তারা সেই চেষ্টাও ছাড়েনি।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যখন অস্ত যায়, তখন পাকিস্তানের জিন্নার সাথে একজোট হয়ে এই রোহিঙ্গারা একটি আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়। কিন্তু সেটা করতেও তারা ব্যর্থ হয়। একবার ভাবুন পাঠক, ১৯৪৭ সালে রোহিঙ্গারা মুজাহিদ পার্টি গঠন করে, যারা জিহাদি আন্দোলনকে সমর্থন করতো। মুজাহিদ পার্টির লক্ষ্য ছিল আরাকানে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তারা জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে ১৯৬২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত অত্যন্ত সক্রিয় ছিল।
এখন একটা সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্রকে আপনি ধর্মীয় পরিচয়ে ভাঙবেন এটা কী সেই রাষ্ট্রের সরকার মেনে নেবে? নাকী তারা কলেমা পড়ে সবাই মুসলমান হয়ে যাবে? নে উইন তাদেরকে দমনের জন্য দুই দশকব্যাপী সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন।
উল্লেখযোগ্য একটি অভিযান ছিল ‘কিং ড্রাগন অপারেশন‘ যা ১৯৭৮ সালে পরিচালিত হয়। এর ফলে রোহিঙ্গারা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসে এবং শরণার্থী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য সংখ্যার রোহিঙ্গারা পাকিস্তানের করাচীতে চলে যায়। সৌদিতেও বর্তমানে প্রায় ৫ লক্ষ রোহিঙ্গা রয়েছে। বার্মার রোহিঙ্গা মুজাহিদরা আরাকানের দূর্গম এলাকায় এখনও সক্রিয় আছে। তাদের সাথে এই দুই দেশের জঙ্গি সংগঠনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। জঙ্গীপনা ও জিহাদি কার্যক্রমে তারা বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে।
https://www.youtube.com/watch?v=40_ja77WqLo
অনলাইনে ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিও টেপে দেখলাম তাদের এক নেতা ভাষণ দিচ্ছেন রোহিঙ্গা মুজাহিদিনদের। যা বলছেন তার ভাবার্থ করলে দাঁড়ায়- যতোক্ষণ পর্যন্ত একজন কাফির এই দেশে (মায়ানমারে) আছে, ততোক্ষণ পর্যন্ত তাদের এই জিহাদ চলবে। সময় এখন এদের কতল করার। লোকটি অস্ত্র হাতে নিয়ে বলছিল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার পরেই তাদের এই জিহাদ শেষ হবে।
এখন ভাবুন বাংলাদেশের বন্ধুরা, মায়ানমারের সরকার কী তাদেরকে জামাই আদর করবে? নাকী লাথি দিয়ে ওই দেশ থেকে তাড়াবে? রোহিঙ্গারাতো মায়ানমারের অস্তিত্বই স্বীকার করে না। যেমন বাংলাদেশে করে নাই রাজাকাররা। তারা এদেশে ইসলামি শাসন কায়েম করতে ১৯৭১ সালে নিজেদের দেশের হিন্দু, আওয়ামীলীগ আর মুক্তিবাহিনীসহ ৩০ লক্ষ মানুষকে ধর্মের নামে হত্যা করতে পাকিস্তানি ‘মুসলিম ভাইদের’ সহায়তা করেছে।
কাদেরকে এই দেশে আনতে চাচ্ছেন? তাদের ঘটনা দেখুন। দলে দলে সশস্ত্র রোহিঙ্গা মুজাহিদিন। ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গারা রাখাইন এক মেয়েকে ধর্ষণ করার কারণে স্থানীয়রা রোহিঙ্গাদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পরে। যেটা আর্মি পর্যন্ত গড়ায়। এই রোহিঙ্গাদের আনতে চাচ্ছেন? একদিন এরাই বলবে কক্সবাজার-চট্টগ্রামকে স্বাধীন রোহিঙ্গা ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে চাই। তখন আপনি যাবেন তাদের সাথে যুদ্ধ করতে? নাকী তখন টিভি দেখবেন আর বলবেন- রোহিঙ্গারা সহি মুসলিম নয়। তাদেরকে সাপোর্ট দিতে পাকিস্তান তো বসেই আছে, সৌদিও আছে। নিজের দেশের জঙ্গি সামলাতেই হলি আর্টিজানের ঘটনা ঘটে যায়। আপনাদের আরও – আরও লাগবে?
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি যখন এই অঞ্চলের বৌদ্ধ আর হিন্দুদের নিজের মাটি দেশ থেকে বিতাড়িত করেন তখন আপনারা তাকে বাহ বাহ দিয়ে বলেন বীর! আর এখন মায়ানমারের সরকার যখন তার দেশের সার্বভৌমের ওপর সরাসরি হুমকিস্বরূপ এমন জঙ্গি গোষ্ঠীকে নিধন করে, তখন তারা আপনার চোখে হয় অত্যাচারী- বর্বর- অমানবিক! এটা আপনার কেমন বিবেক? একপেশে জাজমেন্ট হয়ে যাচ্ছে না?
‘ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়’ কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যায় বারবার।
পাকিস্তানের সাথে ‘মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই’ বলে থাকতে গিয়েছিলেন। ভাইয়ে বাংলাদেশেরে গেলমানের মতো আদর কইরা দিছে। এখনো পাছার ব্যথা যায় নাই, অথচ মুসলিম রোহিঙ্গা দেশে আনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছেন।
মায়ানমারের লোকজন কী ৮ম শতাব্দীতে মুসলামনদেরকে দাওয়াত দিয়ে এনেছিল? ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজিকে কী রাজা লক্ষ্মণ সেন দাওয়াত দিয়েছিল- ভাই আসেন? আমার অঞ্চলে সব কচু কাটা করে যান?
মুসলমানরা যেই এলাকায় যাবে সেখানেই তারা ইসলাম কায়েম করে ফেলতে চায়। আরে আশ্চর্য! তাদের সেটা করা থেকে প্রতিহত করলেই কাফের, মুরতাদ বলে জিহাদের ডাক দিয়ে ওই অঞ্চলের শান্তির বারোটা বাজিয়ে দেয়।
সৌদি তার দেশে কোনও অমুসলিমকে নাগরিকত্ব দেবে না। কারো ধর্ম সংস্কৃতি সৌদিতে প্রকাশ্যে পালনে বিধি নিষেধ দিয়ে রাখবে, কিন্তু মুসলমানরা অন্য দেশের সব সুযোগ সুবিধা নিয়ে- সেই দেশের লোককেই সেই দেশ থেকে বিতারিত করে ইসলাম কায়েম করতে চায়। এটা সবাই মানবে কেন? উজবেকিস্তানের বাবর আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারতে ইসলামি শাসন নিয়ে আসলো। মক্কা মদিনা থেকে সব ইহুদি প্যাগানদের চিরতরে বিতারিত করলো আরবরা। তাই আরবি জাতরা- ওদের উত্তরসূরিরা এটাই চাইবে। যে দেশেই তারা আশ্রয় নেবে, একসময় পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ হারাম বলে- দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে, সেই দেশেই ইসলামি খেলাফত কায়েম করতে চাইবে।
মায়ানমারের সরকার এটা তার দেশে হতে দেবে না।
এখন বলুন বাংলাদেশ থেকে এই অঞ্চলের মূল অধিবাসী কত তাড়িয়েছেন? হিসাব আছে? রোহিঙ্গারাতো মায়ানমারের অরিজিন না। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দুরাতো এই অঞ্চলের ফাউন্ডার। এখন বলেন তাদের জন্য কী বিধান?
শুধু ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় এই দেশ থেকে তাড়িয়েছেন ৩০,০০০০ হিন্দু। যারা এই অঞ্চলের মূল অধিবাসী। এখন পর্যন্ত ২০১৬ সাল পর্যন্ত তাড়িয়ে দেয়ার সংখাটা কত হবে? আপনার বিবেক কী বলে? ১৯৭১-এ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে ১,০০০০০০০ লোক। তার সবাই কিন্তু ফিরে আসে নাই। ফেরৎ না আসা সংখ্যাটা সম্ভবত ১.৩ মিলিয়ন হবে। নিজের দেশের ভিতরে সংখ্যা লঘু নির্যাতন করে আমাদের কী লজ্জা লাগে না আবার অন্য দেশের মানুষকে নিয়ে আদিখ্যেতা দেখাতে? কতোজন রোহিঙ্গা মায়ানমারে? ৮ লক্ষ? তারচেয়ে ১০ গুণ মানুষেরও বেশি মানুষ নিজের দেশ থেকে তাড়িয়েছি আমরা। আমাদের বিবেক তখন কোথায় ছিল? History is always repeating itself…
যদি আপনি বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকেন, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে, স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, তাহলে নিজের দেশের সমস্যা নিয়ে নিজে সচেতন হোন। অন্যকে সচেতন করুন। রোহিঙ্গা মুজাহিদিনরা মায়ানমারে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়, আর মায়ানমার সরকার তার দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে চায়। তাদেরকে তাদেরটা তাদের নেতাদের সাথে বুঝতে দিন।
৮,০০০০০ রোহিঙ্গা নিয়ে না ভেবে বরং আপনি আপনার দেশকে নিয়ে ভাবুন।
একবার ভাবুন যে- আপনার নিজের দেশে ৪৪,৮০,০০০ পরিবার গৃহহীন। রোড একসিডেন্টে প্রতি বছর ১২,০০০ মানুষ মারা যায়। ৩৫,০০০ হাজার পঙ্গু হয় চিরতরে। ১৭ কোটি জনগণের এই দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা ৪০%। প্রতি তিন থেকে চার মিনিটে একজন নবজাতক শিশুর মৃত্যু হয়। বছরে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১,২০,০০০ জন। আমাদের এই শহরের ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ মৃত্যু উপত্যকার ঝুঁকিতে আছে ভূমিকম্পের।
রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে মানবতা? আর নিজের দেশের মানুষের ক্ষেত্রে উদাসীনতা? কোনটা আপনার ফার্স্ট প্রায়োরিটি হওয়া উচিত? নিজের বিবেককে প্রশ্ন করেন? করেন?
ট্রাফিক জ্যামে প্রতি বছর আমাদের মতো একটি দরিদ্র দেশে নষ্ট হচ্ছে ১৯,৫৫৫ কোটি টাকা। খাবারের সাথে ফরমালিন খাচ্ছেন। নিজে বিষ খাচ্ছেন সন্তানকেও খাওয়াচ্ছেন। আমাদের বাতাসে দূষণের মাত্রা এলার্মিং পর্যায়ে।
যে নগরীতে বড়জোর ৩০ লাখ লোক কোন মতে ভালভাবে বাস করতে পারে সেখানে স্থায়ীভাবে বাস করছে ১কোটি ৩০ লাখ লোক। মানে বাড়তি ১ কোটি লোক ঢাকা নগরীতে বাস করে।
এ ছাড়া প্রতিদিন এ নগরীতে প্রায় ২০ থেকে ৩০ লাখ লোক আসে আবার তারা কাজ শেষে ফিরে যায়। অর্থাৎ ১ কোটি ৩০ লাখ অতিরিক্ত লোক প্রতিদিন ঢাকা নগরীতে চাপ প্রয়োগ করছে। এ অতিরিক্ত লোকের জন্য নেই ভাল থাকার ঘর , রাস্তা ঘাট, স্বাস্থ্য পরিসেবা, খাবার পানি। উপরন্তু এরা ৩০ লাখ লোকের জন্য বরাদ্দ সবকিছুতে ভাগ বসিয়ে তাদের জীবনটাও দূর্বিসহ করে তুলেছে। যে কারণে ঢাকা মহানগরী এখন পৃথিবীর সবচাইতে বাজে একটা নগরীতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ কোনও নগর রাষ্ট্র নয়। একটি নগর রাষ্ট্র না হয়েও এই দেশের জনসংখ্যা নগর রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি। বিশ্বে সবচাইতে বেশি মানুষ বাস করে চীন ও ভারতে, যাদের জনসংখ্যা যথাক্রমে ১৩৪ কোটি ও ১২০ কোটি। অথচ তাদের দেশের জনঘনত্ব মাত্র যথাক্রমে ১৩৯ ও ৩৬২ জন প্রতি বর্গ কি. মি.। যদি বাংলাদেশের সমান জনঘনত্ব চীন ও ভারতে হতো তাহলে তাদের দেশের জনসংখ্যা দাঁড়াতো যথাক্রমে– ১০৮৫.৫ কোটি ও ৩৭৩ কোটি, বাড়তি জনসংখ্যার নেতিবাচক চাপ পড়ছে সব খাত ও পুরো দেশের জনজীবনে। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অশিক্ষার হার ও অপরাধপ্রবণতাসহ নানা জটিল সমস্যা। প্রতি বছর ঢাকায় কাজের জন্যে আসছে ১০,০০০০০ মানুষ।
বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই। ঢাকার মধ্যে বিশেষ করে রেললাইনের পাশে যেভাবে ঝুপড়ি ঘর বেধে হাজার হাজার মানুষ বসবাস করে, তাদের নেই কোন পয়: নিষ্কাশন ব্যবস্থা, সুপেয় পানি। দেখা যায়- যেসব জায়গায় ময়লা জমা করে নিচু জমি ভরাট করা হচ্ছে তার পাশেই মানুষ বস্তিঘর বেধে ভয়াবহ দূর্গন্ধের মধ্যে বসবাস করছে। দেখা যায়, দূর্গন্ধ এতোটাই প্রকট যে এমনকী বেওয়ারিশ কুকুর পর্যন্ত সেখানে যায় না, অথচ মানুষ দিব্যি সেখানে বসবাস করছে। এরচাইতে আর বেশি কীভাবে মানুষ অপমানিত হতে পারে?
এ প্রসঙ্গে ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত এক জনসভায় বলেছিলেন,
“ভাইয়েরা আমার, একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রতি বছর আমাদের ৩০ লাখ লোক বাড়ে। আর আমাদের জায়গা হলো ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি প্রতি বছর ৩০ লাখ লোক বাড়ে তাহলে ২৫-৩০ বছর পর কোন জমি থাকবে না চাষ করার জন্য। মানুষ মানুষের মাংস খাবে।”
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, অবশ্যই দেশের এক নম্বর জাতীয় সমস্যা জনসংখ্যা।
ফেসবুকে নানান দেশের সিনেমার, কিংবা আলাদা আলাদা ভিন্ন ঘটনার বীভৎস ছবি ফটোশপ এডিট করে, সত্য উল্টাইতে পারবেন না।
মায়ানমারে ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠায় মায়ানমার সরকারের সাথে যুদ্ধরত রোহিঙ্গা মুজাহিদিন মুসলমানের চেয়ে- আমার দেশের এইসব ইস্যু অনেক বেশি জ্বলজ্বলে সত্য।
দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আপনার দায়িত্ববোধকে প্রায়োরিটি দিতে শিখুন। আপনার দেশের এইসব ভয়ংকর- তীব্র- প্রকট সমস্যার কী সমাধান হতে পারে সেটা নিয়ে ভাবুন। আপনার পরামর্শ দিন। আলোচনা করুন। মানুষকে সচেতন করুন। এতেই দেশের কল্যাণ। এটাই মানবতা। আগে নিজের দেশের মানুষকে বাঁচান। নিরাপত্তা দিন। শান্তি আনুন। তারপর অন্য দেশের সমস্যা নিয়ে ভাববেন।
আগ্রহীরা বাড়তি তথ্য হিসেবে পড়তে পারেন-
১) Yegar, Moshe (2002). “Between integration and secession: The Muslim communities of the Southern Philippines, Southern Thailand, and Western Burma/Myanmar“. Lanham. Lexington Books, Oxford.
২) বাংলা ট্রিবিউন: ‘রাখাইন রাজ্যে ৮৬ জন হিন্দুকে হত্যা’
৩) বিবিসি: সামাজিক মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের ছবি: কতটা সঠিক?
নোট: লেখাটির কিছু প্রাথমিক ভার্সন গতবছর (২৬ নভেম্বর) আমার ফেসবুক টাইমলাইনে প্রথম প্রকাশ করেছিলাম। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আজকে আপডেট হিসেবে নতুন করে নবযুগ ব্লগে প্রকাশ করলাম। এবং আরও লেখার ইচ্ছে আছে।