আর মাত্র তিন বছর পরে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার জন্য সবচেয়ে প্রাচীন বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে পরবর্তী একশত বছরে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক, রাজনৈতিক অর্জন অনেক। দুনিয়াতে আর কোন বিশ্ববিদ্যালয় সমগ্র জাতিসত্ত্বার সাথে এমন গভীর ভাবে জড়িত আছে কীনা সন্দেহ। বাংলাদেশের অভ্যুদয়, জাতীয়তাবাদ এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আবার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থতারও শেষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেটা মূল কাজ, গবেষক তৈরি করা, ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানতৃষ্ণা জাগিয়ে তোলা সে কাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেকাংশে ব্যর্থ। “You can lead a horse to water, but you can’t make it drink”, তেমনি ছাত্রদের বই-পুস্তকের জ্ঞান গুলিয়ে খাওয়ানো শিক্ষার উদ্দেশ্য নয়, বরং ছাত্রেরা যাতে নতুন নতুন ধ্যান-ধারণার সাথে পরিচিত হয়, তাদের ভেতরে যেন জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বাড়ে সেটা নিশ্চিত করাটাই শিক্ষার উদ্দেশ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার এ উদ্দেশ্য নিশ্চিত করতে মোটামুটিভাবে অসফলতার পরিচয় দিয়ে আসছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বিবেচনায় একাডেমিক গবেষণা, জ্ঞানচর্চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান খুবই হতাশাজনক। সবচেয়ে দুঃখজনক, একটা দেশের সবচেয়ে পুরাতন শিক্ষায়তন হিসেবে গত একশত বছরে এখানে গবেষণার কোন ঐতিহ্য বা পরম্পরা সৃষ্টি হয়নি।
বলতে দ্বিধা নেই এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাম করার মত যা কিছু হয়েছে সব হয়েছে কলা অনুষদ থেকে, আরও ভালভাবে বলতে গেলে সাহিত্যে। এটি একমাত্র শাখা যেখানে নতুন গবেষণা হয়েছিল এবং বলার মত কিছু নাম সেখানে পাওয়া যায়। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহাম্মদ আব্দুল হাই, আহমদ শরীফ, আহমদ ছফা, বুদ্ধদেব বসু, মোহিতলাল মজুমদার এরকম আরো অনেককে সেখানে পাওয়া যায়।
সাহিত্যের তুলনায় বিজ্ঞান অনুষদের অবদান অনেক কম। শুনতে অস্বাভাবিক মনে হলেও এটা সত্য যে গড়পড়তা বিজ্ঞানের ছাত্রের চেয়ে সাহিত্যের ছাত্রদের কল্পনা শক্তি অনেক বেশি। তাদের মধ্যে গোঁড়ামি কম, তারা অনেক বেশি মুক্তমনা। বাংলাদেশে বিজ্ঞানের জগতের কেউ কেউ নাম করলেও সেটা তাঁরা করেছেন তাঁদের সাহিত্যিক কর্মের জন্য। কাজী মোতাহার হোসেন, হুমায়ূন আহমেদ, কুদরাত-ই-খুদা, আব্দুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন এরা সকলেই বিজ্ঞানের জগতের মানুষ হয়েও তাঁরা তাদের সাহিত্যিক লেখার জন্যই বেশি পরিচিত। তাই আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাইদের কাছ থেকে অনু্যোগ শোনা যায়, ‘বাংলাদেশে বিজ্ঞানী হলে বুদ্ধিজীবী বলা হয় না, কিন্তু কেউ কবিতা বা প্রবন্ধ লিখলে তাঁকে বুদ্ধিজীবী বলা হয়’। দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের দিকে তাকালে বুঝা যায় যে, সঙ্গত কারণেই সেটা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একাডেমিক দর্শনচর্চায় উল্লেখযোগ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডীর বাইরে চেনে এমন কারও নাম পাওয়া যায় না। দেশের কয়জন মানুষ গোবিন্দচন্দ্র দেব, সরদার ফজলুল করিমের নাম জানেন? তাই একবিংশ শতকে এসেও সারাদেশে দার্শনিক হিসেবে পরিচিত হন বরিশালের অজ পাড়াগাঁয়ে থাকা, অর্ধশিক্ষিত আরজ আলী মাতুব্বর। তিনি ব্যক্তিগত রাগ, ক্ষোভের জায়গা থেকে ধর্মগ্রন্থের খুঁত বের করতে লেগে যান, ফলে তার দর্শন একাডেমিক দর্শনের মত মান সম্পন্ন হয়ে ওঠতে পারে না। বাংলাদেশে তাই এখনও দর্শন বলতে যা চর্চা হয়, সেটা লোকজ, বাউল দর্শন। একশত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন চর্চা করেও আমরা একাডেমিক অঙ্গনে কোন দর্শন বা দার্শনিককে পেলাম না। সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায়ও তেমন কোন স্ফুলিঙ্গ দেখা যায় নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবীদের শিরোমণি ছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সাথে তাঁর নাম ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। খুবই আশ্চর্যজনক হলো, অধ্যাপক হলেও তিনি নিজে কোন প্রকাশনা করেননি, বই লেখেননি। বিলেতে গবেষণার সময় তাঁর পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কি মারা গেলে থিসিস জমা না দিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ফলে অধ্যাপক রাজ্জাকের কোন ডক্টরেট ডিগ্রি ছিল না। এটা ঠিক যে জ্ঞানের সাথে ডিগ্রির সম্পর্ক নেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের জন্য পিএইচডি পর্যায়ের গবেষণা অত্যন্ত জরুরি। নতুন জ্ঞান তৈরি এবং গবেষণার জন্য প্রকাশনার গুরুত্বও অনস্বীকার্য, তা না করে অধ্যাপক রাজ্জাক বাঙালি আবেগে ডিগ্রি না নিয়ে সক্রেটিসের ভাব নিয়ে স্ব-মহিমায় দীর্ঘ চার দশক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা চালিয়ে গেছেন। ইতিহাস, রাজনীতিতে অধ্যাপক রাজ্জাকের কোন মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ আছে কী না জানা নেই। আছে শুধু কিংবদন্তী আর গল্প। বাংলাদেশ সফরে এসে স্বল্প সময়ের মধ্যেও আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর দেখা করতে এসেছেন এতেই আমরা মোহিত হয়ে পড়ি। কিন্তু সেই কিসিঞ্জার আজকে নব্বই বছর পেরিয়েও সমানে লিখে যাচ্ছেন। অপরদিকে অধ্যাপক রাজ্জাক তাঁর ‘বাঙালি মুসলমান’ তত্ত্বের বাইরে যেতে পারেননি। বাঙালি হিন্দুদের কারণে চাকরি-বাকরিতে কোণঠাসা হয়ে মধ্যবিত্ত মুসলমানের ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি সাম্প্রদায়িক অবস্থান থেকে ইংরেজ আমলে ফারসি জানা মুসলমানরা কীভাবে, কেন হারিয়ে গেল সেটা জানতে আগ্রহী ছিলেন। যার ফলে তাঁর ব্যক্তিগত কোন প্রকাশনা না থাকলেও শিষ্যদের ভেতরে ‘বাঙালি মুসলমান’ জিনিসটা স্বার্থকভাবে ঢুকিয়ে যেতে পেরেছেন। এর শুরুটা একাডেমিক, ভাল অর্থে হলেও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে ওঠা পরবর্তীকালের বুদ্ধিজীবীদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। আর এখন তো বাঙালি মুসলমান শক্তিশালী রাজনৈতিক পরিচয়।
দুনিয়াতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যাদের বয়স ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেকের চেয়েও কম, অনেক পরে যাত্রা শুরু করেও এসব বিশ্ববিদ্যালয় আজকে গবেষণায়, জ্ঞানচর্চায় ঢাকার চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম অবদান দেশের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে একটা কেরাণি শ্রেণী তৈরি করা। কে কোন বিষয়ে ব্যাচেলর করছে সেটা কোন ব্যাপার না, পদার্থবিদ্যা, পালি, ইতিহাস, দর্শন সবারই গন্তব্য সরকারি অফিসের চাকরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু হবার প্রথম দিককার সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত এটা একট সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। সেই ত্রিশ, চল্লিশের দশকেও দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সরকারী চাকরি পেলে ‘ভদ্র সমাজের মধ্যে ওঁচা’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকরি ছেড়ে চলে যেতেন। এখনও শিক্ষকেরা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের কাছে হেনস্থা হলে আফসোস করেন যে, তিনি যদি সচিব হতেন বা পুলিশের বড়কর্তা হতেন তাহলে এসব ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীরা তাকে এভাবে অপমান করতে পারত না। কেন আমাদের নিম্ন-মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে ওঠে আসা মানুষেরা শিক্ষক জীবনের দারিদ্র্য সহ্য করে যাবেন? একটু ভাল, স্বচ্ছল জীবনের জন্যই তো এত পড়াশোনা, তাই যদি না হলো তাহলে আর এত পড়াশোনা করে কী লাভ হল?
আমাদের দূর্ভাগ্য যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একশত বছরের ইতিহাসে শিক্ষকতার দারিদ্র্যকে মেনে নিয়ে ক্ষ্যাপা, পাগলের মত গবেষণা নিয়ে মেতে থাকবে এমন ‘পাগলা’ শিক্ষক-গবেষক আমরা পাইনি। এটা সত্য যে আমাদের শিক্ষা-গবেষণায় বরাদ্দ কম, তাই চাইলেও সব সময় সব কিছু পারা যায় না। কিন্তু যেসব বিষয়ে গবেষণার জন্য দামী যন্ত্রপাতি, কেমিক্যালস, অবকাঠামো লাগে না, কেবল বই-পুস্তক আর নিরলস অধ্যবসায়, ‘লেগে থাকা’কে সম্বল করে এগিয়ে যাওয়া যায় সেসব বিষয়েও কোন উল্লেখযোগ্য অবদান দেখা যায় না। একজন রামানুজন হতে তো আর কাঁড়ি কাঁড়ি পয়সা লাগে না। আমরা আজও তেমন নিষ্ঠাবান, গবেষক-অধ্যাপক পেলাম না যারা শিক্ষা-গবেষণার মহান পেশায় আত্মনিয়োগ করে, সমাজের সমালোচনা, শিক্ষক রাজনীতি, লোকনিন্দাকে অগ্রাহ্য করে নিজের গবেষণা নিয়ে মেতে থাকবেন। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম গবেষক যদি দশজনও পাওয়া যায় তাহলে খুব অল্প সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মানচিত্র পালটে যেতে বাধ্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই, আমরা চাই দেশের সবেচেয়ে পুরাতন এ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায়, গবেষণায় আন্তর্জাতিক মানে উত্তীর্ণ হোক। বর্তমানে অনেক তরুণ গবেষক আছেন যারা বিদেশে গবেষণা করে দেশে গিয়ে কাজ করতে চান, কেউ কেউ দেশে থেকে কাজ করার চেষ্টা করছেন। তারা মনে করেন না ‘পিএইচডি গবেষণা’ই কারো জীবনের শেষ গবেষণা, বরং ডক্টরেট ডিগ্রি কোন বিষয়ের স্বাধীন গবেষণার জন্য নতুন গবেষক হিসেবে অভিষেকের প্রথম ধাপ। এসব ‘তরুণ তুর্কি’রা দেশের সীমিত বাজেটে গবেষণা করে আন্তর্জাতিক মানের প্রকাশনা করতে চান। ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ হিসেবে আমাদের উচিত তাদের উপযুক্ত প্রণোদনা দেয়া, শিক্ষা-গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো, তাহলে এরা গবেষণার জগতে অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলতে পারে। আমি আশাবাদী সঠিক পদক্ষেপ নেয়া হলে আজকের তরুণ গবেষকেরা নতুন কিছু করে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলতে সক্ষম হবে, সে শক্তি তাদের আছে।
অক্টোবর ৯, ২০১৭; ৪:৪০ অপরাহ্ন
ঐতিহ্যের পূনর্নিমাণ জুরুরী আজকে। নয়তো দেশের ভবিষ্যৎ তত সুখকর নয়।