৭৬৫ বার পঠিত
বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব, সুনাম, সম্মান সেখানকার লেখাপড়া বা গবেষণার সাথে সম্পর্কিত নয়। একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল। দেশের বাকি সব কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রশাসনিক কাজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা সম্পাদিত হতো। এটা কোন ছোটখাট কাজ নয়, দেশে শিক্ষার বিস্তারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান তাই অনস্বীকার্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার তৎকালীণ পূর্ববাংলার মানুষের জন্য একটা পাশ্চাত্য ভাবধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। শুরুতে অনেকে এর বিরোধীতা করলেও খুব শীঘ্রই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়ে নেয়। শুরুর দিকে অনেক ইওরোপিয়ান পণ্ডিত ব্যক্তি এখানে শিক্ষকতা করেন। তারা শিক্ষা-গবেষণাসহ নানা প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করেন। তারপরে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত দেশী সম্প্রদায় তৈরি হলে তাঁরা এর দায়িত্ব নেন।
গরীব দেশে বিশ্ববিদ্যালয় তথা উচ্চ শিক্ষার মূল লক্ষ্য চাকরির বাজারে মূল্য সৃষ্টি করা, নিজেকে সেইল করার উপযুক্ত করে তোলা, একটা ভাল চাকরির ব্যবস্থা করা। সেটা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির প্রথম দিকেও যেমন ছিল এখনো তেমন আছে। প্রথম দিকে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিল না। এখনো শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার চেয়ে ডিগ্রি সার্টিফিকেট এবং চাকরির যোগ্যতা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ বেশি।
বাংলাদেশের যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অযোগ্যতা তুলে ধরতে হলে শিক্ষার প্রতি সমগ্র জাতির মনোভাবের পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। এছাড়া শিক্ষা-গবেষণা বাজেট, গবেষণার স্বাধীনতা এসব না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করাও ঠিক না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক কারিকুলাম বিবেচনা করলে এটি একটি মাস্টার্স কলেজ। কিছু ক্ষেত্রে ফোর ইয়ার্স কলেজের মত। এখান থেকে অনেক পিএইচডি দেয়া হয়েছে সেটা ঠিক, কলা বিভাগের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হতে পারে। আমি যতদূর জানি সায়েন্স এর বিভাগগুলোতে গ্রাজুয়েট লেভেলের কোন কোর্স নেই, গবেষণার জন্য ন্যূনতম যেসব মেশিনপত্র দরকার সেসব নেই। শিক্ষার কারিকুলামে কোন আপডেট নেই। শিক্ষা পদ্ধতিতে কোন সৃজনশীলতা নেই। যাকে বলে ‘কাটিং এজ’ নলেজ, ইনফরমেশন, সেসবের বালাই নেই। শিক্ষকেরা মান্ধাতার আমলের নোট, চোথা নির্ভর। তারা বিদেশে পিএইচডি গবেষণা ও সেসব প্রতিষ্ঠানের গর্বে গর্বিত। কারো ক্ষেত্রে পিএইচডির রিসার্চই তাদের জীবনের একমাত্র গবেষণা। ছাত্র-ছাত্রীরাও সারাবছর না পড়ে পরীক্ষার আগে ঠেসে মুখস্থ করে পরীক্ষার হলে গিয়ে উগরে দিয়ে আসে। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ধারিত হয় চাকরির প্রতিযোগিতায় কারা এগিয়ে আছে।
বাজেট, শিক্ষার পরিবেশ, একাডেমিক রিসোর্স এসব বিবেচনা করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এরমধ্যে যতটুকু দিচ্ছে সেটা ঢের বেশি। বাংলাদেশের জনগণের চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। বাঙালি মুসলমানের মন এর বেশি চায় না। দুনিয়াতে ব্যবসা করার জন্য, ‘করে খাওয়ার জন্য’ যতটুকু চাপাবাজি শেখা দরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে কিছুদিন ঘুরাফেরা করে সেটা জেনে নিয়ে যে জানে না তার সাথে ফাপড় নিতে পারলেই কেল্লাফতে। সাথে প্রতিষ্ঠানের গোমর, কাল্টিস্ট আচরণ এসব তো আছেই। দেশের সব জায়গাতে ‘আমরা আমরাই’। বাহ কি মজা! এর বেশি আর কি চাওয়ার থাকতে পারে। সেজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কি সাবজেক্ট পড়ল, সেখানে কি পড়ানো হলো, কি শিখলাম এগুলোর কোন গুরুত্ব নেই। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারা এবং যেকোন প্রকারে একটা ডিগ্রি বের করে নিতে পারলে বাংলাদেশে সে কিছু না কিছু করে খেতে পারবে। এখন চাইলে সেটা বেচে বিদেশেও যাওয়া যায়। মানুষও এর বেশি চায় না। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে নানা অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি অফার করতে দেখা যায়। যেসব ডিগ্রির বাজার মূল্য আছে সেগুলো রাতের শিফটেও পড়ানোর ব্যবস্থা আছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে শিক্ষা-গবেষণায় অর্থ বরাদ্ধ বাড়লে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান এমনিতেই বেড়ে যাবে। আধুনিক গবেষণা অনেক খরচের ব্যাপার। শিক্ষা-গবেষণার পরিবেশ বজায় রাখতেও অনেক খরচ আছে, সদিচ্ছার প্রয়োজন আছে। এসব নিশ্চিত করা গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবারো তার হারানো গৌরব ফেরত পাবে, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সারা দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করে নিতে পারবে।
শিক্ষা, ডিগ্রি, সনদ বিতরণের চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব এর আন্দোলন সংগ্রামের দিকগুলো। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, এর পরের গণ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের পরে গণতান্ত্রিক মুক্তির সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনেক। বাঙালি জাতি সেটা অস্বীকার করতে পারবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক মূল্যায়নে তাই সেখানকার পড়াশোনার চেয়ে রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্যের গুরুত্ব বেশি। এই একটি জায়গায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। একটা জাতির মানস গঠনে, রাজনৈতিক আন্দোলন, সংগ্রামের সূতিকাগার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক দুনিয়ার ইতিহাসে তাই অনন্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একশত বছরের ইতিহাস বাংলাদেশের বাঙালিদের মানসিক উৎকর্ষের ইতিহাস। এর সাথে একটা জাতি, তাদের সংস্কৃতি, রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্খা, অর্থনৈতিক মুক্তি সবকিছু জড়িত। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে বাঙালি মুসলমানের যা কিছু অর্জন তা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরে শেখা। একশত বছর পূর্তিতে তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিনন্দন!
জল-জংলার দেশে এমনিতে কোন স্থাপত্য টিকে থাকে না, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো শতবর্ষী কিছু ভবন টিকে আছে। এসবের কিছুই ফেলনা নয়। যেভাবে বাংলাদেশ থেকে সকল ধরণের প্রতিষ্ঠান নাই হয়ে যাচ্ছে সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার গৌরবের ইতিহাস নিয়ে মাথা উঁচু করে এখনো টিকে আছে এটাই বা কম কিসে!শতবর্ষে তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বমহিমায় টিকে থাকুক। এই শতকে বাংলাদেশ ডুবে না গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ু আরো এক শতাব্দী বাড়ুক এই কামনা করি।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন