নকশালবাড়ি আন্দোলনের ৫৩ বছর। একগাদা বই পত্তর নিয়ে কয়েকদিন পড়ছিলাম। ভেবেছিলাম নকশাল আন্দোলন নিয়ে কিছু একটা লিখব, কিন্তু আনু স্যারকে নিয়ে পোস্ট দেবার পর যা হলো তাতে কিছু না বলে চুপ থাকা ঠিক হবে না। সে কারণে এ লেখা। দীর্ঘ লেখা।
এই বাক যুদ্ধে ‘গালি’ শুরু কোথায়?
মোহাম্মদ তানজিউদ্দিন খান প্রথমে যে তীর্যক শব্দটি পিনাকী ভট্টাচার্যের ওপর প্রয়োগ করেছেন সেটি হলো তার ভক্তরা ‘অন্ধ’ এটা বলে। কোনো মানুষকে এরকম প্রেক্ষিতে ‘অন্ধ’ শব্দটি প্রয়োগের নানান কারণ থাকতে পারে। এনলাইটমেন্ট অর্থে এটি বলা হয়ে থাকতে পারে। আর এটার প্রকৃত জবাব তানজিম উদ্দিন খানই দিতে পারেন। ফলে এ আলাপে আমি যাব না। কিন্তু তানজিম উদ্দিনের আলাপে যাওয়ার মত একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ অত্যান্ত অশ্লিল গালি দিয়ে চিকিৎসক সাহেবই তা বন্ধ করে দিয়েছে।
আমি বিষয়টি যখন পিনাকী ভট্টাচার্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম, তিনি আমাকে বললেন ‘ইতর বলাটা যদি তীর্যক মন্তব্য হয় তাহলে বলার কিছু নেই‘। কিন্তু খুব অবাক করা বিষয়, তানজিউদ্দিন খানের মন্তব্যের কোথাও ‘ইতর‘ শব্দটি পেলাম না।
অধ্যাপক তানজিম উদ্দিনের ব্যবহৃত ‘অন্ধ‘ শব্দটি পিনাকী ভট্টাচার্যের স্পষ্টতই বিরোধীতা আছে, কিন্তু সে বিষয়ে বাহাসে না গিয়ে এই ব্যক্তিগত আক্রমণের মর্মবস্তুটা ঠিক আসলে অন্য কোথাও থেকে উৎসারিত।
এই যে আমি বলেছিলাম, পিনাকী ভট্টাচার্যকে নিয়ে বামপন্থিদের অস্বস্তি রয়েছে। একইভাবে চিকিৎসক পিনাকীরও বামপন্থিদের বিষয়ে অস্বস্তি রয়েছে। তারই বর্হিপ্রকাশ ‘অন্ধ‘ এবং পাল্টা প্রতিরোধ হিসেবে অশ্রাব্য গালিগালাজ। আমি বরাবরই বলি, শব্দ নামক যে বোমা তার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হোক রাজনীতির ব্যাখ্যায়। পিনাকী ভট্টাচার্য তানজিম উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে ‘শুয়োরেরবাচ্চা, মাদারচোদ, গোয়া মারার হুমকি, বাকশালী তেল খাইয়া নাদুসনদুস হইছেন একটু গুয়ামারাতো খাইতে হবে‘ এমন সব বিষয়ে এনেছেন।
পিনাকী ভট্টাচার্য যতগুলো গালি দিয়েছেন তার মধ্যে জন্ম বিত্তান্ত নিয়ে গালিগুলো নারীর ওপর নিপিড়ন এটা তিনি আমার চেয়ে কম বোঝেন না-তা না। এগুলোকে তিনি নিন্মবর্গের ভাষা হিসেবে চালাতে পারেন না (এটা আমার বিবেচনা), কারণ তিনি নিন্মবর্গের মানুষ বা সাবলটার্ন না। এমনকী বাংলাদেশে আপনি যতদিন তিনি ছিলেন তার সম্পর্কে তিনি যতখানি ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন তাতে এটা প্রমাণ করা কঠিন যে, তিনি নিন্মবর্গের মানুষের সংস্কৃতি ও তাদের বিদ্যমান সমাজের ভেতরে কোনো ধরণের অনুশীলন করেন। তাহলে এই গালিগুলোকে নিছক নিন্মবর্গের মানুষের মুখের ভাষা বলে মিস্টিফাই করার সুযোগ দেখছি না। বরং এগুলো নারীর ওপর পুরুষের নীপিড়ন এবং ক্ষমতার দম্ভ যা নিপিড়িত মানুষের ওপর নিপীড়কেরা করে থাকেন-সে হিসেবেই দেখছি, দেখার বিস্তর সুযোগ রয়েছে।
অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে ‘বাকশালী তেল খাইয়া নাদুসনদুস হইছেন একটু গুয়ামারাতো খাইতে হবে‘-এই যে অভিযোগ এনেছেন ও হুমকি দেওয়া হয়েছে, তার যে ভিত্তি সেই বাকশালী তেল খাওয়ার বিষয়টি কী প্রমাণ করতে পারবেন চিকিৎসক দাদা? আমিও চাই আপনার বক্তব্যটা আপনি অন্তত তানজিম উদ্দিন স্যারের বিরুদ্ধে প্রমাণ করুন। তানজিম উদ্দিন স্যারকে নিয়ে আমি একটা কয়েক’শ পৃষ্টা লিখতে পারতাম, কিন্তু এখানে ছোট একটা প্যারা লিখব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একদম হাতেগোনা যে দু চারজন মানুষ আছেন, যারা এখনো অন্যায় নিপিড়ন দেখলে প্রতিবাদ করেন তার মধ্যে তানজিম স্যার একজন। ওয়ান ইলেভানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগস্টে যে ছাত্র বিক্ষোভ হয়েছিল সেখানে তার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই আন্দোলনে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, বামপন্থি বিভিন্ন সংগঠন, শিক্ষকদের কী ভূমিকা ছিল তা নিয়ে ২০১০ সালের সম্ভবত ২৫ আগস্ট একটা বিস্তারিত লেখা কালের কন্ঠে লিখেছিলাম, ওয়েবে পাওয়া গেলো না। যে জরুরী অবস্থা ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়েছিল সেই ইর্মাজেন্সি থেকে রাষ্ট্র বেরিয়ে আসতে পারেনি। এই রিজিমটা তার শুধু এক্সটেনশন।
ফলে তানজিম স্যারের ওয়ান ইলেভান বিরোধী ভূমিকা এবং করপোরেট-সিভিল-মিলিটারি-এনজিওরা ক্ষমতা পেলে তেল-গ্যাস কীভাবে তাদের অধিনে নেয় তা নিয়ে তার ভয়াবহ প্রয়োজনীয় থিসিস রয়েছে। মূলত এটি তার পিএইচডি থিসিসও বটে। যাক সেসব কথা।
আপনি তানজিম স্যারকে ‘বাকশালী তেল খাইয়া নাদুসনদুস হইছেন একটু গুয়ামারাতো খাইতে হবে‘ বলেছেন। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের সঙ্গে মিছিল সমাবেশ করে শহীদ মিনার থেকে ফেরার সময় ১৫ জুলাই ২০১৮ সালে ছাত্রলীগের আক্রমণের শিকার হন। আপনি তাকে ‘বাকশালী‘ বললেও ছাত্রলীগ তাকে তখন বলেছিল ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জন্ম নেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজিম উদ্দীন খানকে উদ্দেশ করে ছাত্রলীগের এক কর্মী বলেন, ‘এই শিক্ষকের তো চুল পেকে গেছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি।’ (সূত্র: ১৫ জুলাই ২০১৮, প্রথম আলো)। প্রথম আলোতে এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন ও ছবি দেখতে পারেন।
তারা শুধু তানজিম উদ্দিনের ওপর হামলা করেই ক্ষান্ত হননি-ছাত্রলীগ তানজিম উদ্দিনের বাসা পর্যন্ত ধাওয়া করেছিল। পড়ে দেখতে পারেন ডেইলিস্টার ১৫ জুলাই ২০১৮ সালের রিপোর্টটা ঢাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে ‘ছাত্রলীগের হামলা’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্তৃক লাঞ্ছিত হচ্ছেন তানজিম উদ্দিন খান
আপনার অস্বস্তি ‘শাহবাগে’
আগেই বলেছি আপনার ও বামদের পরস্পরের মধ্যে অস্বস্তি আছে। সেটির কেন্দ্র শাহবাগ। এক সময়ের প্রবল শাহবাগ আন্দোলনের সমর্থক আপনি শাহবাগকে এখন ফিল্টার হিসেবে দাড় করিয়েছেন। কিন্তু তার পর্যালোচনার ভিত্তি কী? ফলে এখানে শাহবাগ দিয়েই অস্বস্তি কথনের প্রথম বিষয়টিতে নিয়ে কথা হোক।
পিনাকী ভট্টাচার্য ছাড়া ছাড়া ভাবে আপনার বিভিন্ন লেখা পড়ে যতখানি বুঝতে পেরেছি (যদি ভুল না হয়), আপনি মনে করেন শাহবাগে ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়েছে। শাহবাগ তৈরিতে যেহেতু বামদের ভূমিকা আছে সে কারণে হরেদরে বামদেরকে ফ্যাসিবাদের উত্থানের জন্য আপনি দায়ি করেন। আমি এই দুটো বিষয়কেই সরল ন্যারেটিভ মনে করি। কেন করি? সেটা বিস্তারিত আলোচনা, সেদিকে না গিয়ে খুব সংক্ষেপে আমি তথ্য দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো।
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন শুরু হয় মূলত কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিকে কেন্দ্র করে। ট্রাইব্যুনালের রায় প্রত্যাখান করে প্রথম মিছিল হয় যৌথভাবে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী, ছাত্র ফেডারেশনসহ কিছু প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন। আমাকে সেদিন ক্যাম্পাস থেকে দুপুরের দিকেই এ মিছিল হবে সেটির খবর জানানো হয়।
এই আন্দোলন কারা গড়ে তুলেছে তখনকার একটি রিপোর্টের দিকে চোখ বোলাতে পারবেন, সেখানে বাকি বিল্লাহ, অনুপম সৈকত শান্ত, পারভেজ আলম, ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী সজিব ও লাকিসহ দেখুন কত জনের নাম আছে দেখতে ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সালে কালের কন্ঠের এই প্রতিবেদনটি দেখতে পারেন এখানে: যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ: তাঁরা মুক্তচিন্তা আর শর্তহীন গণতন্ত্রের নির্ভীক সৈনিক
এর আগেই অনেকে শাহবাগের দিকে যাত্রা শুরু করে। এদের মধ্যে ঘোষণা দিয়ে যাত্রা শুরু করেন অনেকে। এরপর বিকালের পর সেখানে বাকি বিল্লাহর নেতৃত্বে (ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি) একটি মশাল মিছিল আসে। এই মিছিলটা আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তারা শাহবাগ অবরোধ করে।
শাহবাগে আমি পৌছাই রাত দশটার দিকে। সেখানে গিয়ে দেখলাম মানুষ ছোট ছোট জটলা করছে। ৯০ শতাংশ সাবেক ও বর্তমান বামপন্থিকর্মী নেতা। স্বাভাবিকভাবেই আমার সাথে নানান ধরনের টিপাটপ্পনি চলছিল। এরমধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা ডেইলি স্টারের রিপোর্টার পারভেজ ভাই আমাকে বললেন দৈনিক পত্রিকা দরকার, পত্রিকা দিয়ে তারা যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিকৃতি বানাবেন। তখন আমি থাকতাম গ্রীনরোডে। সম্ভবত ৫০/৬০ কেজি খবরের কাগজ (তিনটি পত্রিকা প্রথম আলো, ডেইলিস্টার ও কালের কন্ঠ) এনে দিয়েছিলাম। সেসব খবরের কাগজ ছিঁড়ে ছিঁড়ে শিল্পীরা বানালেন যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিকৃতি। দাবি খুব সিম্পল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে। এর একটা দাবি ছিল সেটা হলো, যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে অভিযুক্ত জামাত ইসলাম নিষিদ্ধ করতে হবে (তখনো এ দাবি খুব জোরের সাথে উঠেনি)।
সারারাত জেগে জেগে নানান ধরনের কর্মসূচী ও যোগাযোগ চলছিল। সকাল নয়টার দিকে আমি বাসায় ফিরলাম, দুপুরের পরে এসে দেখি বোয়ান বা ব্লগার অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব নিয়ে নিয়েছে।
এরপর কী হলো? এরপরও বামরা শাহবাগে পড়ে ছিল। তারা আওয়ামী লীগের নেতাদের দিকে বোতল ছুঁড়ে মেরেছে। সে কারণে লাকি আখতারকে ছাত্রলীগকে পিটিয়ে বারডেমে পাঠিয়ে দেয়। লাকির আহত হওয়ার রিপোর্টটি পড়তে পারেন ‘স্লোগানকন্যা লাকী এখনো হাসপাতালে‘।
মঞ্চ দখলের তীব্র চেষ্টা সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের ছিল। তবে এরকম আন্দোলন থেকে যারে তারে রাজাকাকার আলবদর ভাবাপন্ন তালিকা ঘোষণা মোটেও ঠিক ছিল না। সেটা আন্দোলনকারিদের মধ্যে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে এসব নিয়ে বিরাট তর্ক হয়েছে, কিন্তু তারা পরাজিত হয়েছেন।
যাই হোক এরকম পরিস্থিতিতে বিএনপি শাহবাগ আন্দোলনকে ইতিবাচক হিসেবে চিহ্নিত করল। বিএনপির মির্জা ফখরুল নয়া পল্টন পার্টি অফিসের সামনে সমাবেশে বললেন,
”যেকোনো মূল্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন। সরকার ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। তারাই নিয়োগ দিয়েছে প্রসিকিউশন টিম। ওই টিমই যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করেছে। এখন ওই ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছেন, তা জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই এই সরকারের ক্ষমতায় থাকার আর নৈতিক অধিকার নেই।”
তিনি আরও বললেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন। বিস্তারিত পড়তে দেখুন ‘বিক্ষোভ সমাবেশে মির্জা ফখরুল: ক্ষমতায় গেলে বিএনপি সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবে‘।
এমনকী খালেদা জিয়া শাহবাগ আন্দোলনকে সমাজের আরও বৃহত্তর অন্যায় অসাম্যর বিরুদ্ধে দাড়ানোর আহবান জানান। এবং শাহবাগের তরুণদের এই আন্দোলনকে দলীয়করণ সম্পর্কে সজাগ থাকার নির্দেশ দেন। মূলত আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিয়াস করিম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে হুমকির বিষয়ে খালেদা এই স্টেটমেন্ট দেন। কিন্তু তিনি শাহবাগকে নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন তখনো করেননি যতক্ষণ না পর্যন্ত এটি পুরোপুরি সরকার কব্জা করেছে। খালেদা জিয়ার বিবৃতি পড়ুন এখানে: ‘শাহবাগের তরুণদের পরামর্শ – দলীয়করণ সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে: খালেদা জিয়া‘।
খালেদা জিয়া বিবৃতিতে বলছেন,
“জনগণের মধ্যে স্পষ্ট ধারণা সৃষ্টি করতে হবে যে শাহবাগের এই আন্দোলন দল-মত নির্বিশেষে তরুণ সমাজের আন্দোলন। শাহবাগ চত্বরে সরকারের ভয়াবহ অপকীর্তিগুলো যুক্ত করে একটা সর্বজনীন আন্দোলনের সম্ভাবনাকে ব্যর্থ করতে ক্ষমতাসীন মহলের সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত সম্পর্কেও তাদের সচেতন হতে হবে। তাদের মঞ্চে ক্ষমতাসীন জোটের কর্মীদের তৎপরতা থাকলে তা মানুষকে সন্দিহান করে তুলবে। ওই মঞ্চ থেকে দেশ ও দশের প্রতি সহমর্মী, সত্যনিষ্ঠ ও দৃঢ়চেতা সাংবাদিক-শিক্ষাবিদদের হুমকি দেওয়া হলে তাতে শাহবাগ আন্দোলনের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ন হবে বলে জনগণ মনে করে।”
খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যর সাথে আমি ২০০ ভাগ একমত। বরং খালেদা জিয়ার এই অসনী সংকেত সেদিন আন্দোলনকারি যদি নিতেন, সেদিন যদি না বলতেন বাংলা পরীক্ষার দিন অংক পরীক্ষা দেই না’ শাহবাগ শেষ পর্যন্ত জনগণের আরাধ্য আন্দোলনে পরিণত হতো। সেটা করা যায়নি, সেই ক্রিটিকতো আছেই। কিন্তু শাহবাগ ফ্যাসিবাদ তৈরি করেছে এবং তা বামরাই ঘটিয়েছে এই ব্যাখ্যা বামপন্থিদের বিরুদ্ধে গণহারে ঘৃনা ছড়ানো।
গণজাগরণ মঞ্চ ক্রমশ সরকারি অংশ শক্তিশালী হতে হতে গোটা মঞ্চ দখল করে। এ জন্য তারা হামলা হুমকি বহু কিছু করেছে। যখন গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে কিছু বললে তাকে রীতিমত জামাত শিবিরের দোশর বানানো হচ্ছে (এই প্রবণতা দিয়ে ফ্যাসিবাদের উত্থান বলা যাবে না। তাহলে বামপন্থী বলতেই নাস্তিক মুরতাদ তাদেরকে সাইজ করো, তাদের বিরুদ্ধে অব্যাহত ঘৃণা ওয়াজ মাহফিল ও বক্তৃতায় বিভিন্ন ইসলামি দলগুলো করে বেড়ায় সেটাকেও ফ্যাসিবাদের বীজ হিসেবে দেখতে হবে)। কিন্তু ঠিক সেই কঠিন সময় আমি দুটো বড় নিউজ করে বলেছিলাম গণজাগরণ মঞ্চ আওয়ামী লীগ দখল করছে। এর একটি সম্ভবত ১৫ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অন্যটি ১৭ মার্চ ২০১৩ সালে। এর মধ্যে প্রথম রিপোর্টটি পেলাম না পরের রিপোর্টটি দেখুন এখানে- ‘পথ হারাচ্ছে আন্দোলন: গণজাগরণ মঞ্চ শক্তি হারিয়েছে বিভক্তি আর দলীয়করণে‘।
পরিষ্কার শীরোনাম ছিল রিপোর্টটির ‘পথ হারাচ্ছে আন্দোলন গণজাগরণ মঞ্চ শক্তি হারিয়েছে বিভক্তি আর দলীয়করণে‘ । এই প্রতিবেদনটি প্রকাশের একদিন পরে সমকাল একটি প্রতিবেদন করে আমার নাম না লিখে ও পত্রিকার নাম লিখে মোটামুটি জামাতের দোসর বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১০ টা থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল পর্যন্ত টানা শাহবাগে ছিলাম, সেখান থেকেই রিপোর্ট করেছি। ফলে অনেক কিছুর সাক্ষী আমি। কীভাবে ধীরে ধীরে একটা জনসমুদ্র আওয়ামী লীগ দখল করল সেটাও দেখলাম। আওয়ামী লীগের সমালোচনা করাই যায় কিন্তু একটি গণঅভ্যুত্থানমুখী আন্দোলন কীভাবে সরকার তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে কাজে লাগালো সেটি এক অভিনব ব্যাপার ছিল। আমি বলবো এটা আওয়ামী লীগের ক্ষমতা ও যোগ্যতা। বিএনপির যোগ্যতা থাকলে তারা এটিকে সরকার বিরোধীতার দিকে নিয়ে যেতো। যারা বলছেন রাস্তা অবরোধ করে এভাবে আন্দোলন হয় না, তারা ভারতের দিল্লীর শাহিনবাগের অবস্থানকে কিভাবে দেখবেন? তারা তাহরির স্কয়ারকে কীভাবে তাহলে ব্যাখ্যা করবেন?
ভারতে সম্ভব হলে, বাংলাদেশে সম্ভব না? সম্ভব, কিন্তু নেতৃত্ব ও কর্মসূচী এখানে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আমিতো প্রথম দিকে আমার ছাত্রদলের পরিচিত বড় ভাই, বন্ধুদের শাহবাগে দেখেছি। তারা শুধু নেতাদের ঘোষণার অপেক্ষায় ছিলেন। সম্ভবত এটি আওয়ামী লীগ বুঝতে পেরে এমন সব কর্মসূচী মঞ্চকে দিয়ে ঘোষণা করেছে যার মধ্য দিয়ে বিএনপির এই মঞ্চে আসা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন এটিতো ভারসাম্য ও লড়াইয়ে জয়ি হবার বিষয়, মন খারাপ ও অভিমানের বিষয় না।
তো, এরকম একটা গণ আন্দোলনকে ফ্যাসিবাদের উত্থান বলে চিহ্নিত করে তার জন্য সমগ্র বামপন্থী নেতা-কর্মীকে ট্যাগা তারা দেবে না, যারা মাঠে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চান।
শাহবাগে একটা আন্দোলনের শুরু হয়েছিল, তা বামরা শুরু করেছিলেন কিন্তু সেটি ছিনতাই হয়েছে। এটিতো আমাদের একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধও সেরকম হয়েছে। তাই বলে কী আমাদের কারুর সাহস আছে বলার, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তৎপরবর্তী স্বৈরাচার সরকার গঠনের শুরু। এর জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের বিচারের দাবি কী কেউ করেছিল? আমি অন্তত জামাত ইসলাম ছাড়া আর কারুরই মুখ থেকে এমন কথা শুনিনি।
পোস্ট শাহবাগ
শাহবাগ নিয়ে অনেকে দ্বিধায় ভোগেন। মনে করেন সেটা না হলে আওয়ামী লীগ সরকার টানা পরপর আরও দুই মেয়াদে থাকার সুযোগ পেত না। এরকমভাবে যারা ভাবেন তারা একটা ঘটনা দিয়ে গোটা ইতিহাসকে সাজাতে চান। কিন্তু ইতিহাস হলো বাস্তবের অনেকগুলো ঘটনার একটা বড় সম্পাদনাগ্রন্থমাত্র। তার মধ্যে একটা বিশেষ লেখাকে ধরে এনে গোটা ঘটনার ব্যাখ্যা করাটা ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি ঠিক মনে করি না।
প্রথমেই বলেছিলাম ওয়ান ইলেভানের এক্সটেনশন চলছে। ফলে ওয়ান ইলেভান থেকে ছিটকে বহুদুরে চলে যাওয়া বিএনপির পক্ষে ক্ষমতায় ফেরার কোনো আন্তর্জাতিক কারণ ছিল না। দেশীয় কারণ কেবলমাত্র ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য বিষয়টিকে মাটি গরম করতে পারে, কিন্তু সাবজিক্টিভ ফোর্স এখন পর্যন্ত তেনারা।
বিএনপি ভাবলো সাবজেক্টিভ ফোর্স হলো হেফাজত ইসলাম। তারা সম্পন্ন শক্তি নিয়োগ করে শাপলা চত্বরকে সমর্থন দিল। কিন্তু তাদের ভাবা উচিত ছিল বাংলাদেশে দিল্লীর সব থেকে অনুগত ও বিশ্বস্ত মানুষের নাম হলো হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। যিনি শাপলা চত্বরকে সমর্থন করছেন তার পরিণত কী হবে? এটিও গণজাগরণের মত পরিণত ঘটলো। অথাৎ ‘নাস্তিক’ ‘শাহবাগী’দের উচ্ছেদ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তা ক্ষমতাসীন সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের ভোট বৈতরনী পার হতে সহায়তা করল। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোট পর্যন্ত পর্বটি ছিল আস্তিক নাস্তিকের মধ্যেকার কথিত সংগ্রাম। এভাবে গোটা সময় পার হয়ে যখন আওয়ামী লীগ তত্বাবধায়ক সরকার না দিয়ে দলীয় সরকারের অধিনে নির্বাচন করল তখন বিএনপি কীভাবে তা প্রতিরোধ করবে? কারণ গোটা বছরইতো পার করেছে আস্তিক নাস্তিক ভেদ নিয়ে। এক হাতে আওয়ামী লীগের শাহবাগ অন্যহাতে হেফাজত নিয়ে এভাবেই আওয়ামী লীগ সরকার দুর্দান্ত পারফারম্যান্স দেখালেন।
যদি শাহবাগের কারণে ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়, এ জন্য যদি বামপন্থিরা দায়ী হন তাহলে তার রিঅ্যাকশান শাপলাচত্বর খাড়া করে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির আরও শক্তিশালী রিজিম তৈরি করা হয়েছে, সে জন্য কী আমরা হেফাজত ইসলামকে দায়ি করব?
অথচ মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক এবং শ্রমিক কৃষক উভয় হলেন নিপিড়িত। একপক্ষে মৌলানা সাহেবরা আছে অন্যপক্ষে কম শক্তি নিয়ে হলেও বামপন্থিরা আছেন। তাদের মধ্যে ন্যায় ও ইনসাফের ঐক্য হতে পারতো কিন্তু একপক্ষ আরেকপক্ষকে গালাগালি ও ঘৃণা করেই জীবন পার করল। এর জন্য আপনি সব বামদের গালি দিতে পারেন না, আর বামরাও পর্যালোচনা ছাড়াই মাদ্রাসার শিক্ষক ছাত্রদের গালি দিতে পারে না। এটা ভেদ বুদ্ধির বিষয়।
এখনতো আবার নতুন চল শুরু হয়েছে। যদি ইসলামপন্থি দলের কোনো ক্রিটিক করা হয়, গণহারে ইসলাম ফোবিক হিসেবে ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে, নাস্তিক বলা হচ্ছে, ভারতীয় চর বলা হচ্ছে-অথচ এই সীমিত শক্তির বামরাই বিজেপির মুসলিম বিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরোধীতা করছে ( এটাও সত্য, কেউ কেউ আবার মোদির ঢাকা আগমনকেও স্বাগত জানিয়েছে)।
তো, আপনার বিষয়ে বামদের অস্বস্তির অনেকগুলো কারণের একটা বড় কারণ হলো আপনি হরেদরে সবাইকে ফ্যাসিবাদের দোসর বলেন। এটি ঠিক না।
আর গালাগালির ব্যাপারে ফের বলছি, ‘অন্ধ’ বলার কারণে কাউকে বাপ মা তুলে গালি দেওয়া যায় না। ফলে গালির যে প্যান্ডোরার বাক্স আপনি খুলেছেন তার জন্য তানজিম উদ্দিনকে দায় দেওয়া যায়না। আপনার ভাষায় যদি ‘এলিটজিম’ও করে তারপরও বাপ মা তুলে গাল দেওয়া যায়না। এলিটজম দেখালে আপনি শ্রেণি ঘৃণা দেখাতে পারেন (কি দেখাবেন সেটা আপনার বিষয়। কিন্তু অশ্লীল গালি কোনোভাবেই কাম্য নয়)।
আমার পরিচিত অনেকেই মামলা খেয়েছেন, আমিও খেয়েছি। অনেকে জেলে গেছেন, অনেকে দেশ ছেড়েছেন। আমি দুইবার হামলার শিকার হয়েছি। দুইবার পালিয়ে থেকেছি দেশ ও দেশের বাইরে। কিন্তু ফের এসেছি। কিন্তু কাউকে দেখিনি তারা অন্য যারা লড়ছেন তাদেরকে শত্রু হিসেবে জ্ঞান করতে। তার কর্মসূচী, তার প্যাটার্ন হয়তো (আমারও অনেকের কাজ পছন্দ না) পছন্দ না। কিন্তু একদম গণহারে ঘৃণা ছড়াতে দেখিনি।
ফলে যারা বিভিন্নভাবে লড়ছেন তাদের বিরুদ্ধে গণহারে ঘৃণা ছড়ানোটা ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের অংশ নয়, বরং ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনকেই তা ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বি.দ্র.
দাদা, আরেকটা পয়েন্ট তানজিম স্যার সরাসরি আপনার ফলোয়ারদের অন্ধ বলেনি। যারা স্বপ্নে করোনা ভাইরাসের রোগ মুক্তির ফর্মুলা পেয়ে ইউটিউবে প্রচার করে লাখ লাখ ফলোয়ার বানায় তাদের অন্ধ বলেছে। ঠিক তানজিম স্যার বলেছেন হুবহু কৌট করছি-
”ইরে এই সব লোকজনরে এত পাত্তা দেয়ার কী আছে? জীবনে একটা বই পইড়া মনে হইসিলো প্রতারিত হইসি। সেইটা শাহবাগ নিয়া জিয়া হাসানের বই। এখন দেখি দুইজন দুইজনের পিঠ চাপড়ায়! ইউটিউবে দেখবেন – স্বপ্নে পাওয়া করোনাভাইরাস নির্মুলের ফর্মুলা যারা দেয়, তাদের হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ অন্ধ অনুসারী। এটাই আমরা এবং বাংলাদেশ।”
তিনি অন্ধ ফলোয়ার ডিরেক্টলি আপনাকেও বলিনি। দাদা, সম্ভবত এই সওয়াল জবাবে আপনি হারতে যাচ্ছেন।