৫ই জুলাই সন্ধ্যা ৭:৪৫-এ আমার ফেসবুক টাইমলাইনে ‘নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী ও তাঁর বিজেপি কে ধন্যবাদ!‘ শিরোনামে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। সেখানে আমার দেশের সংখ্যালঘু(!) সম্প্রদায়ের অনেকেই লিখেছিলেন, বিদেশের কথা বাদ দিন। অন্য দেশের কথা না ভেবে নিজের দেশের কথা ভাবুন। সেখানে কি হচ্ছে তাই দেখুন!
আমি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উদ্দেশ্যে বলছি; বাংলাদেশের কাছে ভারত এমনই একটি বিদেশ, যে বিদেশে সামান্য বৃষ্টি হলেও পানিটা গড়িয়ে প্রবেশ করে বাংলাদেশে।
ভারত এমন একটি বিদেশ, যেখানে কেউ পান খেয়ে পিক ফেললেও তা বাংলাদেশে পড়ে।
ভারত, বাংলাদেশের কাছে এমন একটি বিদেশ, যে দেশে একজন মানুষ কাঁদলে বাংলাদেশের মানুষ তা শুনতে পায়।
ভারত ইথিউপিয়া নয়। এত দূরে নয় যে, সেখানে কি ঘটলো না ঘটলো তা আমাদের দেখার বিষয় না। যদিও পৃথিবীর যে কোন জায়গার দুর্যোগ থেকে অপর প্রান্তের মানুষ কখনো মুক্ত থাকতে পারেনা। তবুও বাংলাদেশ এবং ভারত এমন দুটি দেশ যে, সেখানকার প্রতিটি ভালো-মন্দ ঘটনা উভয় দেশের মধ্যে সমান প্রভাব এবং প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
আমি বাংলাদেশের বিশেষ করে হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলছি, ভারতের সামনের দিনের রাজনীতি এমন জায়গায় পৌঁছুতে চলেছে যে, তার কারণে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জন্য এক মূহুর্ত শান্তিতে থাকা বড় কঠিন হয়ে যাবে! যত দ্রুত সম্ভব বিবেকবান নাগরিকের জায়গা থেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ঘটনাসমূহ বিচার করে দেখুন এবং নিজের অবস্থান পরিষ্কার করুন। সে দেশের শুভ বুদ্ধির মানুষেরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার আমরা যেন তাদের সহায়ক হতে পারি তাহলেই সকলের জন্য মঙ্গল।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ যেমন, ভারতের মুসলমানদের দেশ নয়। তেমনি ভারত, বাংলাদেশের হিন্দুদেরও দেশ নয়। সুতরাং বাংলাদেশটাকে দেখতে হবে নাগরিকের চোখ দিয়ে। হিন্দুর চোখ দিয়ে নয়। কেবলমাত্র নাগরিকের চোখ দিয়ে দেখলেই তবে বুঝতে পারবো, বাংলাদেশে একজন মুসলমান আর একজন হিন্দু, কে কতটুকু সুবিধা ভোগ করছে!
পরিস্থিতি বোঝার জন্য খুব সামান্য কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরছি। বাংলাদেশে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলিম হওয়া সত্বেও সংখ্যালঘুরা এখানে কি পরিমান সুবিধাভোগ করছে।
চোখ খুলে দেখুন; বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, বিচার ব্যাবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামো, আর্মি, পুলিশ, বিজিবি, এয়ার ফোর্স, নেভি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, এমনকি দেশের মূল চালিকাশক্তি অর্থব্যবস্থাতেও তুলনামূলক আপনাদের উপস্থিতি বেশি রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গর্ভনর, সোনালি ব্যাংকের এমডি ও সিইও, অগ্রনী ব্যাংকের পরিচালক, রূপালি ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং জনতা ব্যাংকের পরিচালক তারা সকলেই হিন্দু।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উচ্চ পর্যায়েও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের উপস্থিতি অনেক বেশি।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) হিন্দু, বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়্যারম্যান হিন্দু, এমনি ভাবে কারিগরি শিক্ষা অধিপ্তরের মহাপরিচালক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব তিনিও হিন্দু, ঢাকা বোর্ডের উপ-কলেজ পরিদর্শক এবং ঢাকা বোর্ডের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিব, হিন্দু সম্প্রদায়ের।
এ ছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-প্রধান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ প্রধান তথ্য কর্মকর্তা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব পদ সহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদ সমূহে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের উপস্থিতি রয়েছে।
ক’দিন আগেও বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি যিনি ছিলেন তিনিও ছিলেন হিন্দু।
এদেশে কতজন ডিসি, কতজন এসপি, কতজন সচিব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের খোঁজ নিলে অবাক হয়ে যাবেন।
এমনকি রাজনীতিতেও দলীয় কর্মকাণ্ডে বড় পদ-পদবীতে, এমপি-মন্ত্রিত্বে তাদের অবস্থান কি পরিমান আপনারা তা ভুলে গেলে চলবে না।
২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার মধ্যে হিন্দু জনগোষ্ঠি ৮.৫ শতাংশ এবং মুসলমানদের অনুপাত ৯০.৪ শতাংশ।
সে হিসেবে বাংলাদেশে মোট হিন্দু জনগোষ্ঠির সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২৩ লক্ষ। অন্যদিকে মুসলমান জনগোষ্ঠির সংখ্যা ১৩ কোটির বেশি। মুসলমান সংখ্যাঘরিষ্ট হওয়া সত্বেও সংখ্যালঘুরা কতটা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাভোগ করছে উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত তালিকায় তা সুস্পষ্ট।
মুসলিমদের মধ্যে লক্ষ্য লক্ষ্য যোগ্য ছেলেমেয়েরা আজ রাজনৈতিক কারণে সরকারি চাকরি, সামাজিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর আপনারা হিন্দু সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তথা ভারত বান্ধব সরকারের কারণে অনেক কম যোগ্যতায়ও বড় আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না।
অথচ একটুখানি খেয়াল করুন, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৮% হিন্দু ৩৩% সরকারি চাকুরী করছে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে ৩০% মুসলিম ২% সরকারি চাকুরী করছে। এর দ্বারাও বুঝা যাচ্ছে হিন্দু এ দেশে কতটা সর্বোচ্চ সুবিধাভোগ করছে।
মনে রাখতে হবে, এদেশে যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই মুসলিম সেহেতু ভালো-মন্দ যে ঘটনাই ঘটুক, সেখানে মুসলিমদেরই অংশগ্রহণ বেশি থাকবে এটিই স্বাভাবিক। আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে যে, সংঘটিত ঘটনার পেছনে সাম্প্রদায়িকতা কতটুকু কাজ করেছে অথবা শ্রেণী অবস্থান কতটুকু কাজ করেছে। একি হিন্দুর উপরে মুসলিমের নাকি দুর্বলের উপরে সবলের অত্যাচার! রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সাম্প্রদায়িকতার সাথে গুলিয়ে ফেললে দেখাটা, বড় ভুল দেখা হবে।
বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য সব থেকে বড় সমস্যা হলো; তারা এদেশের একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে একটি রাজনৈতিক দলের চেয়েও বেশি কিছু মনে করে। আর এই বেশি কিছু মনে করার কারণেই তারা দলটিকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখে। এই দলটির সকল কর্মকান্ডকে তারা অন্ধ সমর্থন দেয় এবং এর নেগেটিভ ফল হলো: বিশেষ রাজনৈতিক দলটিও সেই সুযোগটি নেয়।
যখন ওই রাজনৈতিক দলের কোন এমপি, মন্ত্রী, নেতা-নেত্রীদের হাতে সংখ্যালঘুদের জায়গা জমি দখল হয় এমনকি সেই দলের কর্মীদের হাতে বিশ্বজিৎ নামক নিরীহ খেটে খাওয়া একজন দর্জি শ্রমিক খুন হয়, এদেশের হিন্দুরা তখন নীরব থাকে! জামাত বিএনপি তো দূরের কথা ওই দুর্বৃত্তরা যদি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নাও থাকতো তাহলেও শুধু মুসলিম পরিচয়ের কারণে সেদিন বাংলাদেশের হিন্দুরা এটাকে সাম্প্রদায়িকতা হিসেবে পৃথিবীর মানুষের সামনে তুলে ধরতো।
কিন্তু বহির্বিশ্বে বিশ্বজিৎ হত্যার দায় যতটা না আওয়ামীলীগের ঘাড়ে তার থেকে অনেক বেশি মুসলমানদের ঘাড়ে বর্তিয়েছে। ভারতবর্ষে বেড়াতে বা জরুরি প্রয়োজনে গেলে এই অভিযোগ আমাদের বহন করতে হয়।
আমরা বিস্ময়ের সাথে দেখে থাকি, যখন একজন মুসলিম মা ‘রেনু’ অন্যায় ভাবে শুধু সন্দেহের বশে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় তখন আমাদের সংখ্যালঘু ভাইয়েরা মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। কারণ তাতে করে তাদের সাধের লালিত রাজনৈতিক দলটির শরীরে ব্যর্থতার কালিমা লাগবে— ভয়ে।
অথচ যখনই আর এক জন হিন্দু মা ‘জয়ন্তি’ নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, তখনই আপনারা রি-রি করে উঠে বলেন, এটি সাম্প্রদায়িকতা। সংখ্যালঘু বিধায় তাকে হত্যা করা হয়েছে।
না। এটা ভুল কথা। উদ্দেশ্য মূলক কথা। এটি আসলে রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকারের ব্যর্থতা। এ দায় আমাদের নিতে হবে সকলকে। আড়াল করার কোন সুযোগ নেই, বন্ধুরা।
আসলে যতদিন পর্যন্ত আমরা হিন্দু-মুসলমান উভয়ই রাষ্ট্রের নাগরিক না হয়ে দলকানা সমার্থক থাকবো ততদিন শোষক শ্রেণী, সে যে দলেরই হোক না কেন আমাদের এই অন্ধত্বকে, এই অজ্ঞ-মূর্খতাকে তারা খুব সহজে ব্যবহার করবে এবং করতেই থাকবে!
এ দেশে যেসব মুসলিম কথিত ‘জঙ্গি’দের কথা বলা হয়। যে স্বরূপে তাদেরকে হাজির করা হয়। এর বিন্দুমাত্র যদি বাস্তবে থাকতো তাহলে, বহু লোক— যারা প্রকাশ্যে রাজপথে মানুষ হত্যা করে মৃত লাশের উপরে লাফিয়ে ছিল; যারা মাসের-পর-মাস ঢাকা শহরের সব থেকে ব্যস্ততম রাস্তায় জনসভা করে সমাজকে অশান্ত করেছিল। দেশ কালিমামুক্ত হবে বলে রাষ্ট্রকে সংকটের মধ্যে নিয়ে গিয়েছিল। এইসব ঘটনার রূপকার অনেকেই মুহুর্তের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। এ কারণে ওই ‘জঙ্গিতত্ত্ব’ একটি বড় বিস্ময় ও জিজ্ঞাসা চিহ্ন হয়ে সমাজে এখনও বিদ্যমান আছে এবং বহু দিন তা থাকবে!
এখানে একটি ছোট্ট কথা বলে রাখি- আপনাদেরকে খুশি করতে গিয়ে, অন্যায় সুযোগ দিয়ে এদেশের প্রাচীন ঐতিহাসিক বিশেষ রাজনৈতিক দলটিও কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হৃদয় থেকে দূরে সরে গেছে। তাদের দীর্ঘমেয়াদি রাজনীতির ক্ষতি হয়েছে। হয়তোবা নিকট ভবিষ্যতেও গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেওয়া তাদের জন্য কঠিন হবে!
অথচ এখনো আপনারা তৃপ্ত নন। অসন্তুষ্ট রয়েছেন। দেশের বাইরে গিয়ে দেশ এবং সরকারের বিরুদ্ধে বলে রাষ্ট্রকেই বিপদে ফেলছেন। প্রকান্তরে নিজেরাই নিজেদের চলার পথকে অমসৃণ করছেন! এসবের কোনকিছুই ভালো ফল বয়ে আনেনি এবং আনবও না। এদেশের নাগরিক যেমন নাগরিক হতে পারিনি তেমনি দেশের রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ‘স্টেটসম্যান’ হতে পারিনি, এটিই আমাদের দুর্ভাগ্য!
একমাত্র আমাদের শুভবুদ্ধির উদয়-ই পারে সমাজে বিদ্যমান সংকট থেকে মুক্তির প্রকৃত পথ বাতলে দিতে।
আসুন, আমরা প্রথমে রাষ্ট্রের নাগরিক হই এবং এই ‘নাগরিক’-ই হোক আমাদের প্রথম পরিচয়।