২
১৫১৮ বার পঠিত
আমরা অনেককেই বলতে দেখি হিন্দু ধর্মে জাত-পাত এর একটা বড় সমস্যা। এই সমস্যা এখনো হিন্দুরা অনুসরণ করে চলেছে। কিন্তু কেন? আর কীভাবেইবা এই জাত-পাত এই ধর্মে ঢুকে পড়ল?
প্রশ্নগুলোর উত্তর তেমন কঠিন না হলেও সনাতন ধর্মের লোকজন তা কখনোই জানার চেষ্টা করে না। সনাতন ধর্মের বিধানে উঁচু-নিচু, জাত-বেজাত এর শ্রেণিউল্লেখ করা আছে। নইলে একটা লোকাচার দিয়ে এই ধর্ম এতোদূর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করতে পারতো না। সনাতন ধর্মের বিধানটাই বা কেমন? আসুন একটু সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।
হিন্দুদের ধারণা ‘মনু’ থেকে মানব আর মনুবাদ হচ্ছে ‘মানবতাবাদ’ বা মনুর বিধান। মনুর অনুশাসন বস্তুত হিন্দুর সংবিধান। বহুকাল ধরে বিনা প্রতিবাদে চালু থাকায় রাষ্ট্রের আইনের চেয়ে ‘মনুর’ বিধান অনেক বেশী শক্ত ও দৃঢ়মূল হয়েছে। আইনী বিচারের ক্ষেত্রে একজন বিচারপ্রার্থী হয়ে আদালতে যেতে পারে। সন্তুষ্ট না হলে সে যেতে পারে হাই-কোর্টে। কিন্তু ‘মনুর’ আইনের ক্ষেত্রে তা কখনোই সম্ভব নয়। এর বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ব্রাহ্মণ ও মনুবাদী সমাজ সর্বদা নিয়োজিত। যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজও পরিবর্তন হচ্ছে, এর সাথে দেশের আইনের পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু মনুর বিধানের কোন আইন পরিবর্তন হচ্ছে না। কারণ মনুর বিধানকে বলা হয় ব্রহ্মার মুখনিঃসৃত বিধান। যেমন ইসলাম ধর্মে ‘কোরান’ হচ্ছে আল্লাহর বিধান। আল্লাহর বিধান যেমন পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, তেমনি মনুর বিধানও অপরিবর্তনীয়।
ধর্মের প্রবক্তারা খুব বেশি বুদ্ধিমান না হলেও তাদের চেয়ে ‘বুদ্ধিমান‘ এবং চতুর হচ্ছে এই বিধানগুলো দিয়ে যারা শাসন করে আসছেন তারা। সেই শাসকরা সাধারণ জনগণকে এতোটাই প্রভাবিত করেছে যে, এই বিধানের বাইরে যাওয়ার অর্থই হলো সৃষ্টিকর্তাকে অমান্য করা এবং তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
মনুর বিধান বলতে আমরা যেটা বুঝি তা হচ্ছে ‘মনুসংহিতা’ বা ‘মনুস্মৃতি’। মনু কতোজন কার পুত্র ইত্যাদিতে যাচ্ছি না। কারণ সেটা অনেকেই জানেন। এরচেয়ে বরং ‘মনুসংহিতা’য় কী কী আছে তা একটু দেখে নিই।
মনুস্মৃতিতে মোট ২৬৮৪ টি শ্লোক আছে। এই শ্লোকগুলোতে সন্নিবেশিত গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলো হলো,
ক) পৃথিবীর উৎপত্তি
খ) বিভিন্ন সংস্কারের নিয়ম
গ) ব্রতাচারণ
ঘ) বিবাহের নিয়মাবলী
ঙ) অপরাধের শাস্ত্রীয়বিধি
চ) শ্রাদ্ধবিধি
ছ) খাদ্যাখাদ্যবিধি
জ) বিভিন্ন বর্ণের কর্তব্য
ঝ) বর্ণাশ্রম বিধি
ঞ) স্ত্রী-পুরুষের পারস্পরিক ধর্ম
ট) সম্পত্তি বণ্টনের বিধি
ঠ) সংকর বর্ণের বিবরণ
ড) জাতিধর্ম
ঢ) কুলধর্ম
ণ) ব্রাহ্মণের অধিকার ও করণীয় এবং
ত) রাজা-প্রজার পারস্পরিক কর্তব্য ইত্যাদি।
মোটামুটি বলা যায় হিন্দুদের দৈনন্দিন সামাজিক ও ধর্মীয় কর্তব্যের অলঙ্ঘনীয় বিধি-বিধান নিয়েই ‘মনুস্মৃতি’। এগুলো প্রচলিত আছে মনুর নামে। মনুর ধর্ম চারবর্ণ ভিত্তিক ধর্ম; মনুর মোট ২৬৮৪ শ্লোক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আর্যদের দেবতা ব্রহ্মার পুত্র মনু তার ধর্মের নাম দিয়েছেন ‘সনাতন ধর্ম’।
এই ধর্মে তিনি মানুষকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। যথা,
১) ব্রাহ্মণ
২) ক্ষত্রীয়
৩) বৈশ্য ও
৪) শূদ্র এর প্রথম তিনটি দ্বিজ।
এই কাঠামো দ্বারা তিনি ব্রাহ্মণকে প্রকৃতপক্ষে দেবতার আসনে বসিয়ে একটি স্থায়ী বৈষম্যপূর্ণ ধর্ম প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রতিটি বিধানের কেন্দ্রবিন্দুতে ব্রাহ্মণ। তার স্বার্থকে রক্ষা, সংহতকরা ও নিরঙ্কুশ করাই হচ্ছে মনুর একমাত্র উদ্দেশ্য। এলক্ষ্যে যতো প্রকার নিষ্ঠুরতা দরকার, মনু তা অনায়াসেই করেছেন। শুরু করেছেন চার বর্ণের অলৌকিক ও অবিশ্বাস্য জন্ম কাহিনী দিয়ে।
সনাতন শাস্ত্রমতে জানা যায় কোথা থেকে এই বর্ণগুলোর জন্ম হয়। যেমন, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয়, বৈশ্য ও শূদ্রের সৃষ্টি যথারীতি মুখ, বাহু, ঊরু ও পদ থেকে। কোন মানুষের জন্ম যে মুখ বাহু ঊরু ও পদ থেকে যে হয় না, এ কথা মনু কী জানতেন না? তবু এমন ধরনের একটা কাজ করলেন কেন? শুধু ব্রাহ্মণ, শূদ্র ও নারীদের সম্পর্কে মনুর বিধানগুলো জানলেই এর ঠাণ্ডা মস্তিকের জটিলবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যাবে।
এবার দেখি ব্রাহ্মণদের জন্য মনু কী কী বলেছেন:
ক) স্রষ্টা ব্রাহ্মণদেরকে মুখ থেকে সৃষ্টি করেছেন ( ৩১ নং শ্লোক)
খ) স্থাবর জঙ্গমাদির মধ্যে প্রাণী শ্রেষ্ঠ, প্রাণীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবীরা শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমানদের মধ্যে মানুষ এবং মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ (৯৬ নং শ্লোক)
গ) জাতমাত্রই ব্রাহ্মণ পৃথিবীতে সকল লোকের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হোন এবং সকল সৃষ্টিপদার্থের ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য তিনিই প্রভু (৯৯)
ঘ) পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তার সবই ব্রাহ্মণের সম্পত্তি। শ্রেষ্ঠত্ব ও অভিজাত্যহেতু ব্রাহ্মণ সবই পাওয়ার যোগ্য (১০০)
ঙ) ব্রাহ্মণ নিজের অন্নই ভক্ষণ করেন, নিজের বস্ত্র পরিধান করেন এবং নিজের দ্রব্য দান করেন। অন্য লোকেরা যা ভোগ করে তা ব্রাহ্মণের দয়া হেতু করে (১০০)।
উপরোক্ত শ্লোকগুলো থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় ব্রাহ্মণদের মনু কোথায় রেখেছেন।
এবার দেখি শূদ্র সম্পর্কে মনুর বক্তব্য:
ক) শূদ্র বা দাসদের নিজস্ব কোন সম্পত্তি রাখার অধিকার নেই
খ) দাস ও শূদ্রের ধন ব্রাহ্মণ অবাধে নিজের কাজে প্রয়োগ করবেন
গ) শূদ্র অর্থ সঞ্চয় করতে পারবে না। কারণ তার সম্পদ থাকলে সে গর্বভরে ব্রাহ্মণের ওপর অত্যাচার করতে পারে
ঘ) প্রভু কর্তৃক পরিত্যক্ত বস্ত্র, ছত্র, পাদুকা ও তোষক প্রভৃতি শূদ্র ব্যবহার করবে
ঙ) প্রভুর উচ্ছিষ্ট তার ভক্ষ্য
চ) দাসবৃত্তি থেকে শূদ্রের কোন মুক্তি নেই
ছ) যজ্ঞের কোন দ্রব্য শূদ্র পাবে না
জ) ব্রাহ্মণের পরিবাদ বা নিন্দা করলে শূদ্রের জিহব্বাছেদন বিধেয়
ঝ) ব্রাহ্মণ শূদ্রের নিন্দা করলে যৎসামান্য জরিমানা দেয়
ঞ) ব্রাহ্মণ কর্তৃক শূদ্র হত্যা সামান্য পাপ। এইরূপে হত্যা পেঁচা, নকুল ও বিড়াল ইত্যাদি হত্যার সমান
ট) শূদ্র কর্তৃক ব্রাহ্মণ হত্যার বিচার মৃত্যুদণ্ড
ঠ) শূদ্র সত্য কথা বলছে কীনা তার প্রমাণ হিসেবে তাকে দিব্যের আশ্রয় নিতে হবে। এতে তাকে জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর দিয়ে হাঁটতে হয় অথবা জলে ডুবিয়ে রাখা হয়। অদগ্ধ অবস্থায় অথবা জলমগ্ন না হয়ে ফিরলে তার কথা সত্য বলে বিবেচিত হবে
ড) দ্বিজকে (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয় ও বৈশ্য) প্রহার করলে শূদ্রের হাত কেটে ফেলা বিধেয়
ঢ) ব্রাহ্মণের সঙ্গে একাসনে বসলে তার কটিদেশে তপ্তলৌহদ্বারা চিহ্ন একে তাকে নির্বাসিত করা হবে অথবা তার নিতম্ব এমনভাবে ছেদন করা হবে যাতে তার মৃত্যু হয়
ণ) দ্বিজের ন্যায় উপবীত বা অন্যান্য চিহ্ন ধারণ করলে শূদ্রের মৃত্যুদণ্ড বিধেয়
ত) যে পথদিয়ে উচ্চ বর্ণের লোকেরা যাতায়াত করেন, সেই পথে শূদ্রের মৃতদেহও বহন করা যাবে না। ইত্যাদি।
অনেকেই হয়তো বলার চেষ্টা করবেন, এইসকল বিধান এখন হিন্দুধর্মে মানা হয় না।
এধরনের কথা যারা এখন বলেন, তারা কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে তা বলেন সেটা অবশ্যই ভেবে দেখার বিষয়। কারণ মফস্বল কিংবা ভারতবর্ষজুড়েই এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, যা মাঝে মধ্যেই আমরা পত্রিকার পাতায় দেখতে পাই। সনাতন ধর্মে হয়তো মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠিন শাস্তি নেই, কিন্তু তাদের সেই হিংস্র মানসিকতা এখনো উঠে যায় নি।
এবার দেখা যাক নারীর বিষয় কী কী বলা হচ্ছে:
নারী সম্পর্কেও মনুর বিধান কঠোর ও বৈষম্যমূলক। নারীদের বিষয়ে মনুর দৃষ্টি শূদ্র এর অবস্থান থেকে কোন মতেই তা উচ্চ নয়। যেমন,
ক) স্ত্রীলোক পতিসেবা করবে। তার স্বাধীন কোন সত্তা নেই
খ) নারীকে কুমারী অবস্থায় পিতা, যৌবনে স্বামী, ও বার্ধক্যে পুত্র রক্ষা করবে
গ) স্ত্রীলোকের পৃথক কোন যজ্ঞ, ব্রত বা উপবাস বিধান নেই
ঘ) স্ত্রীলোকের সাক্ষী হওয়ার বা স্বাধীনভাবে ঋণ করার কোন অধিকার নেই
ঙ) বিধবা সাধ্বী নারী ব্রহ্মচর্য পালন করবে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টই দেখা যায় সনাতন হিন্দু ধর্মে বৈষম্য ও বিভাজনের ছড়াছড়ি। সনাতন ধর্মে মানুষকে মানুষ হিসেবে নয়, মানুষকে কিছু মানুষের (বাহ্মণ) অধীনস্ত পশুতূল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
অক্টোবর ৭, ২০১২; ১১:৪২ পূর্বাহ্ন
দাদা, আমি জানতাম আপনি ইসলাম ধর্ম নিয়েই ভাল জানেন। আজকে আপনার পোস্ট পড়ে জানলাম আপনি সনাতন ধর্ম বিষয়েও বেশ ভাল জ্ঞান রাখেন। বিশেষ করে আপনি যেভাবে অতি সহজে সনাতন ধর্মের বিভাজনগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
অক্টোবর ৮, ২০১২; ১১:৪৭ পূর্বাহ্ন
লেখাটি পড়ার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ দাদা।