০
১৬২৪ বার পঠিত
চারিদিকে আজ বসন্ত। আজ ভালোবাসা দিবস। প্রিয়জনকে ভালোবাসা জানানোর দিন। অথচ এমন একটি দিনে আমাদের মতন কিছু মানুষ প্রিয়জনদের প্রেমের কথা চিন্তা না করে রাজপথে নেমে এসেছিলো দেশপ্রেমের টানে। এমন একটি বিস্মৃত দিন থেকে লিখছি। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ এর সে দিন, আমাদের যখন যৌবন। সেদিনও ভালোবাসা দিবসই ছিলো। প্রেমিকার আহ্বান উপেক্ষা করে মিছিলে শামিল হয়েছিলাম। ফুলের বদলে হয়েছিলাম বুলেটের মুখোমুখি। উপহারের বদলে জুটেছিলো লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস। বাসায় ফিরেছিলাম জবাফুলের মতন লালচোখ নিয়ে। হায়, বিস্মৃত বিস্মিত সে দিন।
তবে কি আমরা ভুল করেছিলাম? জাফর, জয়নাল, দিপালীরা অহেতুক জীবন দিয়েছিলো? আমাদের যৌবনটা ভুল মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছিলাম? না হলে, এমনতো হবার কথা ছিলো না। একাত্তরের পর নব্বই আমাদের আবার আশা জাগিয়েছিলো। কিন্তু ছিয়ানব্বইয়ের পর থেকেই সে আশায় গ্রহণ লাগতে শুরু করে। আজ পূর্ণচন্দ্রগ্রহণ। আশার চাঁদকে গ্রাস করেছে রাহু। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি আমাদের জন্য বিরহকাল, বিষাদের দিন।
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে সরাসরি তুলে দিচ্ছি। উইকিপিডিয়া বলছে, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে এবং বাংলাদেশের সংবিধান রহিত করে সাত্তারের জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিসভা বাতিল ঘোষণা করেন।’ একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে অনির্বাচিতদের রাজত্বের শুরু করা স্বৈরাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রথম সক্রিয় প্রতিবাদের দিন ১৯৮৩ এর ১৪ ফেব্রুয়ারি। যা শুরু হয় মজিদ খান প্রণীত শিক্ষানীতিকে কেন্দ্র করে। এই শিক্ষানীতির প্রতিবাদ জানাতে শিক্ষার্থীদের মিছিলে গুলি চলে। নিহত হন জাফর, জয়নাল, দিপালীরা। তৎকালীন ডাকসুর জিএস মোশতাক হোসেন বিবিসি’র কাছে বলেন অন্তত পঞ্চাশ জনের নিহত হবার কথা। যাদের অনেকের লাশও পাওয়া যায়নি। হত্যা আর লাশ গুমের স্বীকৃত প্রক্রিয়া সেদিন থেকেই শুরু। সেই আত্মদানের, উৎসর্গের আপাত সফল পরিণতি ঘটে নব্বইয়ের গনঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে। আমরা ভাবতে শুরু করি আমাদের উৎসর্গকৃত যৌবন বৃথা যায়নি। তাই কি?
ছিয়ানব্বইয়ের পর থেকেই আমাদের ভুল ভাঙতে শুরু করে। বলতে পারেন, ভাঙনের দিন শুরু। পতিত স্বৈরাচারকে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো ১৪ ফেব্রুয়ারির শহীদদের সহ অসংখ্য শহীদের আত্মদান আর আমাদের উৎসর্গকে লজ্জিত করে তোলে। দেশের লজ্জার ইতিহাসের আরেক পর্বের উত্থান ঘটে। যার ধারাবাহিকতা আজো চলমান।
ছিয়ানব্বইয়ের পর থেকেই ১৪ ফেব্রুয়ারি গর্বিত প্রতিরোধের দিনটিকে আড়ালে নেবার, প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। আমাদের সংস্কৃতির সাথে যার কোনো যোগসূত্র নেই, সেই অদ্ভুত এবং বিতর্কিত একটি দিনকে দিয়ে শুরু প্রতিস্থাপনের সে চেষ্টার। যে চেষ্টা আজ সফল। আজ কোনো যুবাকে যদি প্রশ্ন করা হয় স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস বিষয়ে তারা নিরুত্তর থাকবে অথবা এমন জবাব দেবে যা আমাদের লজ্জাকেও লজ্জিত করে তুলবে। এই যে ইতিহাস বিস্মৃত করার একটি আত্মঘাতী প্রচেষ্টা এই প্রচেষ্টা শুধু স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসকেই ভুলায়নি, ভুলিয়েছি ৫২’র ভাষা আন্দোলনকেও। একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রশ্ন করা হয়েছিলো অনেক যুবাকেই, তারা ইতিহাসের কথা বলতে পারেনি। মাথায় ফুলের মুকুটে সেজে শোকের সে দিনকে কেউ আনন্দের দিন বলেছে! লজ্জা, লজ্জা, লজ্জা। টেলিভিশনের সে খবরটির ফুটেজ আজো ইউটিউবে রয়েছে। সুতরাং একটি প্রতিরোধকে আড়াল করতে সব প্রতিরোধকেই লজ্জিত করা হয়েছে। অসম্মান করা হয়েছে সব শহীদকেই।
স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসটাকে বিস্মৃত করতে ব্যবহার করা হয়েছে যুবাকালীন আবেগের সবচেয়ে কোমল দিকটিকে। যে আবেগ মূলত অপ্রতিরোধ্য। আর আমরা সেই অপ্রতিরোধ্যতাকেই মাড়িয়েই গিয়েছিলাম স্বৈরাচার প্রতিরোধে। বিস্মৃত হয়েছিলাম নিজ প্রেমকে দেশপ্রেমের জন্য। আজ বিস্মৃত হচ্ছি আমরা, আমাদের যৌবনের কাল। তাই মনে হয়, সেদিন যদি ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যেতাম তবে আজ হয়তো উজবুক আনন্দে শামিল হতে গ্লানিবোধ করতাম না। হলুদ রঙে হলুদ হয়ে মিশে যেতাম সকল আচারের সাথে, হলুদিয়া উৎসবে!
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন