যে পাঠকরা আমার লেখা বা আমার দর্শনগত কাজের সঙ্গে পরিচিত, নির্ঘাত তাঁরা এই লেখার শিনোনাম দেখে চমকে উঠেছেন। হ্যাঁ, তেমনই প্রায় এক দশক আগে চমকে উঠেছিলেন কিছু দর্শক শ্রোতা। ‘ধর্মের বিদ্বেষ বিলুপ্তিতে হিন্দু-মুসলিম বিবাহ জরুরী’ শীর্ষক এক আলোচনা চক্রে বলতে গিয়ে প্রথমেই ওই শিরোনামের কথাটাই তুলে ধরেছিলাম। স্বাভাবিকভাবে শুরুতেই সেই আসরের তাল কেটে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যা বলার চেষ্টা করেছিলাম তারই কিছুটা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
আজও বেশিরভাগ মানুষ তার ধর্মের পরিচয়টাকে ভীষণভাবে গুরুত্ব দিয়ে মননে লালন করেন। শিশু বয়স থেকেই পরিবার ও সমাজ সেভাবেই প্রত্যেকের মনে ধর্মবোধের বীজ পুঁতে দেয়। যার থেকে জন্ম নেয় এক বিভেদমূলক মহীরুহ। জন্ম নেয় তীব্র জাতের বিচার, সঙ্গে সম্প্রদায় ও আঞ্চলিকতার বিভেদবোধ। উদারনৈতিক পরিবেশ পেয়ে সামান্য কেউ কেউ জাতপাত, সম্প্রদায় বা আঞ্চলিকতার ঊর্দ্ধে উঠলেও বেশিরভাগ মানুষ ‘ধর্ম পরিচয়’টাকে শরীরের হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, বা যকৃতের থেকেও বেশি নিজের মনে করেন। আর একদল তো নিজের মস্তিস্ক ও কাণ্ডজ্ঞানের থেকেও বেশি নির্ভর করেন নিজ ধর্মের কেতাব-শাস্ত্রে। নিজের সারা জীবনের অর্জিত পরিচয়ের থেকেও আরোপিত ধর্ম পরিচয়ে বেশি গর্ববোধ করেন। সাধারণত কোন ধর্মের লোকেরাই চায় না অন্য ধর্মের অনুসারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে। এক্ষেত্রে প্রায় সবাই নিজ নিজ ধর্মকে মেনে চলে। এমনকী একই ধর্মের মধ্যেও চলে জাত-গোত্রের বিচার। মুসলিমদের মধ্যে সুন্নি হলো সর্ববৃহৎ মুসলিম সম্প্রদায়, এর পর আছে শিয়া ও সুফিবাদ। এগুলো ছাড়া আরও আছে- আহমদিয়া, ইবাদি, মাহদি, ইয়াজিদি এবং কুরআনবাদ। প্রভাবশালী ও বিত্তবান মুসলিমরা অনেক ক্ষেত্রে তাদের বিবাহের সময় এইসব সম্প্রদায় মান্য করে থাকেন। আর হিন্দুদের তো প্রায় ছয় হাজার জাতিতে বিভক্ত সমাজ। এর পর গোত্র, ঠিকুজী, কোষ্ঠী, রাশি নানান অবৈজ্ঞানিক পরিচয় খুঁজে বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহের জন্য পাত্রপাত্রী খুঁজতে যে কী হাস্যকর পর্যায়ের তল্লাসি চলে তা রবিবারের দৈনিক খবরের কাগজে পাত্রপাত্রী কলামে চোখ বোলালেই বোঝা যায়।
ইসলাম ধর্মের মানুষ ইসলাম ব্যতীত আর অন্য ধর্মে বিয়ে কখনো সমর্থন করে না। ইসলামের দৃষ্টিতে এই কাজ হারাম এবং অন্যায়। এরকম বিবাহ করলে তারা ইমান হারা হবে। তবে উক্ত, পুরুষ কিংবা মহিলা যদি ইসলাম ধর্মের প্রতি আকর্ষিত হয়ে ইসলামধর্ম গ্রহণ করে, তাহলে বিবাহ বন্ধনে আপত্তি নাই, বরং তাতে সমাদরই আছে।
হিন্দুধর্মের সে সুযোগও নেই। হিন্দু বিবাহ আইনে যেকোন হিন্দুর সঙ্গে হিন্দুধর্মের নানা বিভাগ বা উপবিভাগ (বীরশৈব, লিঙ্গায়েত, ব্রাহ্ম, প্রার্থনা, আর্যশমণ ইত্যাদি)দের বিবাহ বৈধ। এমনকী বৌদ্ধ ও জৈনদের সঙ্গে বিবাহও বৈধ, কিন্তু কখনোই তা মুসলিম, খ্রিস্টান, পার্শি বা ইহুদির সঙ্গে নয়। আর শুধুমাত্র বিয়ের তাগিদে বিয়ের আগে ধর্মান্তকরণ ঘটিয়ে ‘হিন্দু’ হয়ে বিয়ে করার কোনো শর্টকার্ট রাস্তাও নেই।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানব-মানবী যতই একে অপরের প্রেমে দিওয়ানা হয়ে যাকনা কেন, যতই তাদের জীবনদর্শনে মিল থাকুক কা কেন, তারা তাদের লালিত ধর্ম অপরিবর্তিত রেখে কোনো ধর্মমতেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বা যৌথজীবন পালন করতে পারছেন না। কতশত প্রেম অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে যায় শুধু মানব-মানবী ভিন্নধর্মের অন্তর্গত বলে। তাবলে কী হিন্দু-মুসলিম বিবাহের কোন রাস্তাই নেই?
হ্যাঁ, বিকল্প রাস্তা একটা আছে নিশ্চয়ই। এদেশে আছে ‘বিশেষ বিবাহ আইন’ বা স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট। যেখানে পাত্র-পাত্রী যে কোনো ধর্মের বা যেকোন সম্প্রদায়ের হতে পারেন। বৈবাহিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় কোনো বিধিবিধান বাধা হবেনা বা তার কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। পাত্র-পাত্রী দাম্পত্য জীবনে নিজ নিজ ধর্ম পালন বা না-পালন করতে পারবেন স্বাধীন ভাবে। এখন অনেক পাঠক ভাবছেন, তাহলে আর হিন্দু-মুসলিম বিবাহে বাধা রইলো কোথায়। হাজারো বাধা আছে বন্ধু। সমস্যা কিন্তু এতেই দূর হল না, বরং সমস্যার শুরুটাই এখান থেকে। পরে সে বিষয়ে আলোচনা করছি।
বিবাহ কী? এই প্রশ্নের উত্তরে এককথায় কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্র, সমাজ, জাতি, গোত্র ও অঞ্চল ভেদে এর নানান উত্তর হতে পারে। হতে পারে জীবনদর্শন অনুযায়ী অন্য এক আধুণিক ভাষ্য। তবুও মোটামুটি অতি সংক্ষেপে বিবাহ বলতে আমরা যা বুঝি তা হল– একটি সামাজিক বন্ধন বা বৈধ চুক্তি বা পারস্পরিক অঙ্গীকার যার মাধ্যমে দু’জন বিপরীত লিঙ্গের মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এছাড়া বিবাহের মাধ্যমে বংশবিস্তার ও উত্তরাধিকারের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিবাহের মাধ্যমে পরস্পর সম্পর্কিত পুরুষকে সাধারণত স্বামী (পতি) এবং নারীকে স্ত্রী (পত্নী) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ইসলামে মিঞা ও বিবি। আধুনিক মুক্তচিন্তায় জীবনসঙ্গী-জীবনসঙ্গিনী বা বন্ধু-বান্ধবীও ভাবা হয়। নর-নারীর এই যুক্তজীবনকে সাধারণত ‘দাম্পত্য জীবন‘ হিসাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
দুজন বিপরীত লিঙ্গের যুবক-যুবতীর বয়সজনিত কারণে পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসার উন্মেষ ঘটে থাকে(ইদানীং অবশ্য সমলিঙ্গে প্রেম ও বিবাহ স্বীকৃতি পেয়েছে কিছু দেশে)। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই প্রেম-ভালোবাসার মধ্যে কোনো হিসাবনিকাশ থাকে না। সেই পবিত্র উন্মাদনার সময় আগামীর দীর্ঘ সংসার জীবনের আগুপিছু ভাবনার কোনো অবকাশও থাকে না। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে পারস্পরিক মিলনটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। এই সময়ে, সেই যে অতি আপনার ‘ধর্ম’ পরিচয়, তাও পরিবর্তনের শর্তও তারা মেনে নিতে পারেন। আসলে তারা তখন ‘ধর্ম’টাকে গৌণ মনে করে যৌবনের ধর্মটাকেই প্রাধান্য দেন। এপর্যন্তও কোনো সমস্যা নেই।
যৌথ জীবনের প্রথম দিকের কিছুদিন বেশ ‘হঠাৎ ভীষণ ভালো লাগছে’ গোত্রের মনে হয়। পাত্র-পাত্রী যতই সংসার সমুদ্রের গভীরে প্রবেশ করেন ততই বুঝতে পারেন এ যাত্রার আগাগোড়া কোনো প্রমোদতরী ভ্রমণ নয়। দায়-দায়িত্ব, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা, সহ্যক্ষমতা, রুচির নমনীয়তা, পারস্পরিক আস্থা অর্জন ইত্যাদি হাজারো বিষয় যৌথজীবনের সংসারে নিত্যদিনের রসদ। দীর্ঘদিন খুব কাছাকাছি বসবাসের কারণে নানান ছোটখাটো বিচ্যুতি, অবজ্ঞা, অবহেলা, স্খলন ধরা পড়তে পারে পরস্পরের কাছে। একই ধর্মের অন্তর্গত পাত্র-পাত্রী হলেও শুধু উপরোক্ত কারণে পরস্পরের মধ্যে মানসিক দূরত্ব বাড়তে পারে। কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক রুচির তফাতে দুজনের মধ্যে মানসিক ব্যবধানটা দূরে সরে সরে চলে যেতে পারে আলোকবর্ষ পারে। সেখানে দুজন একই সংসারে দুই ধর্ম পালন করলে তা হবে বাড়তি ঝামেলার সূত্রপাত। আমাদের দেশে বিবাহের পর দুজনকে সহধর্মী ও সহধর্মিনী বলার রেওয়াজ আছে। এক্ষেত্রে আমরা এই ‘ধর্ম’টাকে Religion হিসাবেই শুধু ভাববো না, বরং আমরা Quality বা Character হিসাবেই ভাববো। দুজন মানুষের Quality, Character কখনই সম্পুর্ণ এক হতে পারে না। কিন্তু এক রাখার প্রবণতাই যৌথ জীবনের একমাত্র শর্ত হয়ে দাঁড়ায়। সেক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর দুরকম ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-আচরণ লালন করলে, কখনোই তারা সহধর্মী ও সহধর্মিনী নন। অনেক পাঠক ভাবতে পারেন, ধর্মে ধর্মে তো কোনো বিদ্বেষ নেই, বৈরিতা নেই, সব ধর্মই শান্তির কথা বলে ইত্যাদি। যাহা আল্লাহ তাহাই ভগবান। যেমনটা আমাদের অনেক প্রগতিশীল নায়কেরা বলে থাকেন। এগুলো আপাত শুনতে ভাল লাগা কথা। বাস্তবে মোটেই তা নয়।
সংসারের হাজারো সমস্যার মধ্যে ‘ধর্ম’ একগাদা উটকো সমস্যা আমদানি করে স্বাভাবিক যৌথজীবনের ব্যাঘাত ঘটাবে। দুজনের যৌথজীবনে নতুন সদস্যের জন্ম হলে তার নামকরণ থেকে তার ধর্ম কী হবে তা নিয়ে সমস্যা হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেখানে পুরুষতান্ত্রিকতা প্রাধান্য পেয়ে সেই নবাগত তার পিতার ধর্ম পায়। পিতা মুসলিম হলে পুরুষ সন্তানের সুন্নৎ হয়ে সে মুসলিম হবে। পিতা হিন্দু হলে, তিনি যে গ্রেডের হিন্দু (হিন্দুত্বের নানান গ্রেড বর্তমান) সন্তান সেই গ্রেডেড হিন্দু হবে। পিতা ধাঙড় বা দলিত হলে সন্তানও সেই পরিচয়ই পাবে। পিতা ব্রাহ্মণ হলে সেই শিশুর উপনয়ন হয়ে দ্বিজত্ব প্রাপ্তি ঘটবে। যেখানে তার জন্মদাত্রীর ধর্মের বিশ্বাসে এসব ধারণার কোনো স্থানই নেই। অবশ্য শিশুটির মা শিক্ষিত, ব্যক্তিত্বময়ী ও অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হলে তা তিনি নাও মেনে নিতে পারেন। অশান্তি অবশ্যম্ভাবী। দম্পতির দুজন দুই ধর্মের হলে তাদের দুজনের উত্তরাধিকার আইন এক নয়। মৃত্যু পরবর্তী আচার পালনের ক্ষেত্রেও দ্বন্দ আসবে স্বাভাবিক ভাবেই। সংসারের দুজন যদি দৈনন্দিন পুজো-পার্বন, ব্রত-উপবাস, আচার-অনুষ্ঠান, নামাজ-রোজা, মিলাদ-জলসা, দরগা-হজ্ব করে খাঁটি ধার্মিক সাজার চেষ্টা করে, তাহলেই তো সাধের সংসার শিকেয় চড়বে। একজনের ধর্মেকর্মে অত্যাধিক সক্রিয়তা দেখে অন্যজনও পাল্লা দিয়ে তার সক্রিয়তা বাড়িয়ে দিতে পারেন। সংসার শুরুতে হয়তো তিনি অতটা ধার্মিক ছিলেনই না। এই নিয়ে বাড়তে পারে পারস্পরিক ইগো ক্ল্যাশ। সংসারে যখন একটা মিটসেফ ভিষণ দরকার তখন গৃহিণী হয়তো সেই পয়সায় কাঠের সিংহাসন কিনে আনবেন তার বালগোপালের জন্য। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ কর্তামিঞা যখন ঘরে মশা মারা ধুপ খুঁজে পাচ্ছেন না, গৃহিনীর বালগোপালের সিংহাসনে তখন সুগন্ধী ধুপ জ্বলছে। অনেক জরুরি ছিল চা-চিনি রাখার দুটো ষ্টীলের কৌটোর। কর্তামিঞার বোন গিফট করেছেন সে’দুটি। গৃহিনী এতদিনে বালগোপালের তালমিছরি ও নকুলদানা রাখার দুটো মজবুত কৌটো পেলেন। বাড়িতে একটু ভাগবত পাঠের আসর বসানোর কথা কবে থেকে বলে আসছেন গিন্নিমা, সেদিকে কান নেই মিঞার। বছরে দু-দুটো মিলাদের আসর তার দেওয়া চাই মায়ের ইচ্ছায়। গত দুটো পুজোয় বলে বলে একটা জামদানী শাড়ি পাননি গিন্নিমা। ওদিকে বছরে একবার আজমীঢ় শরীফে চাদর চড়াতে টাকার আমদানি যেন কীভাবে হয়ে যায়। এরকম হাজারো খুচরো সমস্যার হাঙর সংসারে ঢুকে পড়বে শুধু ধর্মের খাল বেয়ে। আরও অঢেল সমস্যার লাগাতার যোগান দেবে দুই তরফের ধার্মিক আত্মীয়স্বজন। যা যৌথজীবনের সংসারে কখনোই অপরিহার্য নয়, বরং স্রেফ অপকর্ম। এক ঢপ কেরসিন তেল অনেক অপরিহার্য হয়ে পড়ে সংসারে। হেঁসেলের গ্যাস ফুরালে তা জরুরি উপাদান হয়। অনেক সময় সেদিকে হুঁশ থাকে না ধার্মিকদের। তারা একঢপ গঙ্গাজল বা আবে জমজমের পানি যোগাড় রাখে যত্ন করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কর্তা-গিন্নির ধর্ম উপরোক্তের বিপরীত হলেও কিন্তু ওই একই সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হত। স্ত্রী জাইগুন্নিসা কতদিন স্বামী সোমনাথকে বাজারে যাওয়ার সময় বলেছেন, বকফুল বা কুমড়োফুল আনতে। কতকাল ওইসব ফুলের বড়া খাওয়া হয়নি। রোজ মায়ের কুলদেবতার জন্য পলিপ্যাকে পুজোর ফুল আনলেও বকফুল বা কুমড়োফুল আনতে ভুলে যান কর্তা। দেখা যায়, যার যার ধর্ম যত নিখুঁতভাবে তারা মান্য করবে, সংসারে উটকো ঝামেলা তত নিবিড়ভাবে প্রবেশ করবে। এক্ষেত্রে শুধু হিন্দু-মুসলিম নয়, সংসারের কর্তা-গিন্নি দুজন দুই ধর্মের হলেই ওই একই সমস্যা দেখা দেবে।
এ পর্যন্ত পড়ে প্রিয় পাঠক হয়তো ভাবছেন, হিন্দু-মুসলিম বিবাহের সংসার যে সমাজে এক্কেবারে নেই তা তো নয়। তারা তো দিব্যি আছে বলে মনে হয়। হ্যাঁ আছেন তো। এই লেখকেরই অন্তত দশজন বন্ধু-বান্ধবী আছেন, যারা দুই ধর্মের থেকে এসেও সুখে সংসার করছেন। তারা সমাজে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত। অনেক সমস্যা বা জটিলটা হয়তো তাদেরও আছে আর পাঁচটা সংসারেরই মতো, কিন্তু ‘ধর্ম’ তাদের কোনো সমাস্যার কারণ হয়ে ওঠে না। তারা ওইসব ধর্মের পরিমণ্ডলে জন্মেছেন ঠিকই, কিন্তু যৌথজীবন শুরুর আগেই ওই ধর্ম নামক পুরাতন, জীর্ণ, অবৈজ্ঞানিক, অমানবিক শতচ্ছিন্ন ময়লা পোষাটাকে ত্যাগ করে এসেছেন। জীবনের সমস্ত সঙ্কট ও জটিলতায় তারা মোকাবিলা করেন পার্থিব নিয়মে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও মানবাধিকার রক্ষার আইন তাদের রুক্ষাকর্তা। অপার্থিব কোনো সর্বশক্তিমানের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য ও পরজনমের পরম প্রাপ্তিতে তাদের জীবন সমর্পিত নয়। তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মননে ও আচরণে ধর্মের প্রবেশ বন্ধ করে তাদের মানব/মানবীর সন্তান হিসাবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট। তাদের বিদ্যালয়ের ভর্তির ফর্মে ‘ধর্ম’ কলাম কেউ ফাঁকা রেখেছেন, কেউবা ‘মানবতা’ লিখেছেন।
পরিশেষে একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে এ রচনা শেষ করতে চাই। জলপাগুড়ির কোনো গরুর হাট থেকে একটা বলদ কিনে এনে, অপর আর একটি বলদ বর্ধমানের পাণ্ডুয়াহাট থেকে কিনে এনে হালে জুড়ে দিন। তারা কৃষকের উষর জমি সুন্দরভাবে চাষ করে দেবে। দুটি গরুর মধ্যে কোনোদিন দেখা হয়নি, কিন্তু চাষির ভাষা তারা উভয়ই বোঝে। কারণ হালচাষ করতে যে সামান্য ভাষা চাষি প্রয়োগ করেন তা তারা বুঝে নিয়েছে। তাদের আলাদা কোনো ধর্ম নেই, জীবনদর্শন নেই। এটা কিন্তু মানবেতর পশুর ক্ষেত্রেই সম্ভব। উন্নত চিন্তা বা সৃষ্টিশীল চিন্তার কোনো মগজ(Gray Matter) তাদের নেই। কিন্তু একই গ্রামের বা শহরের দুটি পাত্র-পাত্রীকে যৌথজীবনের জোয়ালে যুতে দিয়ে সংসার নামক জমি চাষ করে নেওয়াটা তত সহজ ব্যাপার নয়। এখানেই মানুষ ও জন্তুজানোয়ারের মধ্যের ফারাক। মানুষের চিন্তার জগত কোনো বেড়াজালে আটকে থাকে না। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রভাবে মানুষ যে কত রকম চরিত্রের হতে পারে তার ইয়ত্তা নেই। জিনগত প্রভাবও মানুষের চরিত্রে ছাপ ফেলে। সৃষ্টিশীল বা ধাংসাত্বক চিন্তায় একটা মানুষ যে কোন পর্যায়ে যেতে পারে তা দৈনিক খবরের কাগজ বা মনোবিজ্ঞানের কিছু কেস হিস্ট্রি পড়লেই বোঝা যায়।
এহেন দুজন মানুষের সারাজীবন একসঙ্গে থাকার অঙ্গীকারটাই যেখানে একটা স্পর্ধা। সেখানে বাড়তি আরোপিত ধর্ম পরিচয় শুধু বাহুল্যই নয়, বিপজ্জনকও বটে। তাই হিন্দু-মুসলিম হিসাবে নয়, দুজন মানব-মানবী বা প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে বিয়ে করুন বা যৌথজীবন শুরু করুন। বিশেষ বিবাহ আইনে বা কোনও আইন ছাড়াই পারস্পরিক আস্থায় সংসার গড়ে তুলুন। বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ে বা পারস্পরিক আস্থায় যৌথজীবন শুরু করতেই যখন ‘ধর্ম’ কোনো কাজে লাগলো না, তখন বাকি জীবনে ওটা আর কিসেই বা দরকার?