“বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।“
নারী পুরুষ একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নারীকে ছাড়া পুরুষ যেমন অসম্পূর্ণ তেমনি পুরুষকে ছাড়া নারীও অপূর্ণ। সৃষ্টির শুরু থেকেই তারা একে অপরের ছায়াসঙ্গী, সহগামী, সহযোদ্ধা। নারী-পুরুষ উভয়ের হাত ধরেই সৃষ্টি হয়েছে আধুনিক সভ্যতার।
আরণ্যপর্বে নারী পুরুষ কারুর চেয়ে কারুর মর্যাদা, পেশীশক্তি বা ক্ষমতা কম ছিল না। খাদ্যের প্রয়োজন মেটানোর জন্য তারা একসাথে শিকার ধরেছে, নারীর হাত ধরেই কৃষিকাজের সূচনা হয়েছে, গঠিত হয়েছে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার আর পরিবারকে ঘিরে সমাজ। সেই সমাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানাবিধ আইন, নানা রকমের প্রথা তৈরি করা হয়েছে। বিয়ে সেরকমই একটি প্রথা। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে কোন স্থায়ী বিবাহপ্রথার প্রমাণ পাওয়া যায়না। আর এই বিবাহপ্রথার হাত ধরেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার সূচনা ঘটে। অনেক ইতিহাসবিদগন বিয়েকেই মূলত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মূল স্তম্ভ হিসাবে ধরে থাকে।
সময়ের আবর্তে পুরুষতন্ত্রের উত্থান ঘটার সাথে সাথে নারীর জগত আস্তে আস্তে সংকুচিত হতে থাকে। মানুষের যে জিজ্ঞাসু মন, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও ভয় ঈশ্বর নামক এক অতিপ্রাকৃত শক্তির জন্ম দিয়েছিল সেই ঈশ্বরকেই পুরুষেরা তাদের অর্ধাঙ্গীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা শুরু করে। ক্রমে ক্রমে ঈশ্বর নামক এই অলীক বস্তুটিই তাদের সবচেয়ে বড়, ভয়ানক ও শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়। আর সেই হাতিয়ারই পুরুষকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় একনায়কে পরিণত করেছে। যে হাতিয়ার বর্তমান সময়েও পুরুষরা নারীদেরকে নিজেদের বশীভূত করে রাখতে অজ্ঞানে বা সজ্ঞানে ব্যবহার করে আসছে।
অথচ একই প্রজাতির নারী-পুরুষ নামক দুটি বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীর হাজার বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় যে আধুনিক সভ্যতার সূচনা হয়েছিল সেই সভ্যতা থেকেই যখন পুরুষেরা নিজেদের প্রভুত্ব কায়েম করতে নারীদের অবদানকে অস্বীকার করে, স্বামী সন্তান আর সংসারের পরিধিতে তাদের আষ্ঠে-পৃ্ষ্ঠে আবদ্ধ করে ফেলে, নারীকে শুধুমাত্র নিজেদের ভোগের বস্তুতে পরিণত করে তখনই শুরু হয় সভ্যতার পশ্চাৎগমন।
কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্নের উদয় হয় নারী কেন তাদের প্রতি এই অবিচার, গৃহবন্দীত্ব বিনা প্রতিবাদে মেনে নিল? একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীরা কেন তাদের প্রতি পুরুষদের এই অন্যায়-অবিচার মুখ বুজে সহ্য করছে? কেন তারা কোন জোড়ালো প্রতিবাদ করছেনা?
নারীরা তাদের এই হীন অবস্থাকে ধর্ম আর সৃষ্টিকর্তার বিধান বলেই মানতে বাধ্য হয়েছিল। বর্তমান সমাজের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই আমরা তার প্রমাণ পাই। নারীদের জীবনে যত রকমের বিধি-নিষেধের গণ্ডি আছে, তার সবটাই ধর্ম আর ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে তৈরি করা। তাদের খাঁচায় পুরার জন্য যতোনা স্বর্গের লোভ দেখানো হয়েছে তারচেয়েও বেশি দেখানো হয়েছে নরকের সীমাহীন দুঃখ্য-দুর্দশার ভয়। নারীরাও সেই দুঃখ্য-দুর্দশার গল্প শুনে ভয়ে ভীত হয়েছে, পৃথিবীর কষ্ট সহ্য করতে করতে তারাও মৃত্যুর পর মুক্তি আর একটুখানি সুখের আশা করেছে।
কিন্তু ধর্মগ্রন্থসমূহে স্বর্গকে পুরুষদের জন্য সহজলভ্য করা হলেও নারীদের জন্য তার পথ ভীষণই দুর্গম করে তৈরী করা হয়েছে। আর সেই দুর্গম পথ অতিক্রম করার জন্য পৃথিবীকে তাদের জন্য বানানো হয়েছে এক কঠোর পরীক্ষাকেন্দ্র হিসেবে। পৃথিবীতে পরিবার, সমাজ ও পুরুষ প্রদত্ত সব রকম অন্যায়-অত্যাচার বিনা প্রতিবাদে মুখবুজে সহ্য করতে পারলে, নিজের জীবনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, চাহিদা, স্বাধীনতা সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে বাবা-মা, স্বামী-সংসার-সন্তানদের সেবায় রান্নাঘরে বিনা বাক্যব্যয়ে জীবনপাত করলে তবেই সেই কাংখিত স্বর্গে প্রবেশের অনুমতি মিলবে তাদের।
অবশ্য এসব যে ঈশ্বরের সৃষ্টিকর্তা পুরুষদের নারীদেরকে নিজেদের আজ্ঞবহ দাসীতে পরিণত করার একটা নোংরা চাল ছিল মাত্র তা যে কেউই ধরতে পারেনি তা কিন্তু নয়। যে অল্প সংখ্যক মানুষেরা তা বুঝতে পেরেছে এবং যে একশো জনে একজন মানুষ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছে এবং এখনো যে কণ্ঠস্বরগুলো প্রতিবাদের চেষ্টা করছে কুটবুদ্ধি নয়ত পেশিশক্তি আর ধর্ম রক্ষার দোহাই দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা, দম্ভ, অহংকার ও আধিপাত্য টিকিয়ে রাখার জন্য সেইসব কন্ঠস্বরগুলোকে অতীতেও রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং এখনো তা-ই হচ্ছে।
আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই যেসব সমাজে ধর্ম শক্তিশালী সেসব সমাজে নারীর জীবন সংকীর্ণতার বেড়াজালে আবদ্ধ, তাদের জীবন কুসংস্কারতায় পরিপূর্ণ ও জীবনমান অত্যন্ত নিম্ন। পরিবার, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মজীবন, ব্যাক্তিগত চাহিদা, যৌনচাহিদা, প্রজনন, রাজনীতিসহ প্রায় সকল ক্ষেত্র থেকেই তারা বঞ্চিত। সেসব সমাজে এক অনাকাংখিত পরিবেশে অছ্যুত, পাপযোনী আর বাবা-মায়ের বোঝা হিসেবে তাদের জন্ম, পরজীবী হিসেবে বেড়ে উঠা, বিয়ের পর স্বামীর কেনা গোলাম হয়ে বাকি জীবন স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার, লাঞ্ছণা-গঞ্জনা সহ্য করা এবং সংসারের ঘানি টানার মাধ্যমেই তাদের জীবনাবসান।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন ও লিঙ্গ বৈষম্য সূচক এর গবেষণাধর্মী বিভিন্ন সাম্প্রতিক তথ্যসমূহ আলোচনা, পর্যালোচনা ও বিবেচনা করলে দেখা যায় যেসব সমাজে নারী পুরুষের সমতার মাত্রা একদম নিম্ন, সেসব সমাজে ধর্মের প্রাধান্য অনেক বেশি এবং নারী-পুরুষের সমতার সূচকের একদম নিম্নে থাকা দেশগুলোর সবকয়টিই কট্টর ধর্মান্ধ, ইসলামী শরিয়া /শাস্ত্রীয় আইনের দ্বারা পরিচালিত।
নিম্নে সেরকম কয়েকটি গবেষণাধর্মী তালিকার উল্লেখ করা হল-
১) Human Development Index, UNDP
২) Gender Inequality Index by UNDP
৩) Global Gender Gap Index by WEForum
একজন ধর্মান্ধ ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবেই একজন ধর্মনিরপেক্ষ বা নাস্তিক ব্যক্তির তুলনায় নারীদের প্রতি অনেক বেশি বিদ্বেষী, হিংসাত্মক ও আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন হয়। এর মূল কারণ তাদের হাজার বছরের ধর্মীয় সংস্কৃতি, রীতি-নীতি তাদের এই শিক্ষাই দিয়ে এসেছে। তাদের কাছে মানবতার প্রকৃত শিক্ষার আলো পৌঁছুতে পারেনি। জন্মের পর থেকেই তাদের মস্তিস্কে ধর্ম, নারীবিদ্বেশ ও পুরুষতন্ত্রের ভয়ানক ভাইরাসগুলোকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এ ভাইরাসগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ছে, মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে যাছে তার বিষবাষ্প।
বিপরীতক্রমে দ্য নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ফ্রান্স, জার্মানি ইত্যাদি দেশের উদাহরণ দেওয়া যায়, যেসব ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির চর্চাকারী রাষ্ট্র লিঙ্গবৈষম্যের একদম নিম্নপর্যায়ে রয়েছে। সেসব দেশে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির প্রচলন রয়েছে বলেই সেসব দেশের নারীরা স্বাধীন, তাদের জীবনমান অপেক্ষাকৃত উন্নত এবং তাদের জীবনের বিভিন্ন দিকগুলোও অনেক বিস্তৃত।
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের লিঙ্গবৈষম্যের নিম্নপর্যায়ে থাকার মূল কারণ হিসেবে যে কারণটিকে উল্লেখ করা যায় তা হলো ধার্মিকদের তুলনায় ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিরা নারী-পুরুষের সম-অধিকারে অনেক বেশি বিশ্বাসী। ধর্মের সংকীর্ণতা ও আজগুবি তত্ত্বে তারা কখনোই বিশ্বাসী বা আস্থাশীল নয়। এমনকী যেসব সমাজে অস্ত্রের দ্বারা জোরপূর্বক ধর্মনিরপেক্ষতা স্থাপন করা হয়েছে সেসব সমাজেও নারী পুরুষের সমতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ আমরা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা এখানে উল্লেখ করতে পারি।
কিন্তু কোন ধর্মীয় ঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই ধর্মপ্রাণ বা মৌলবাদী বিশ্বাস ও রীতিনীতির অনুসারী লোকেরা সবসময়ই নারীর পছন্দ-অপছন্দ, ব্যক্তিগত স্বাধীনতাসহ সকল ক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করে এসেছে। তাদের ভূমিকা ও ক্ষমতায়নকে হ্রাস করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, ইসলা্ম ধর্মে বহুবিবাহ, শিশুবিবাহ, ধর্ষণ, দাসী সহবত, বিধর্মী কতল, জিহাদ, তিন তালাক প্রথাসহ এমন আরো অনেক প্রথার প্রচলন রয়েছে যা সভ্য সমাজে কল্পনাতীত। মৌলবাদী ইসলাম জন্মনিয়ন্ত্রণকে নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম নারী-পুরুষেরা তাদের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখে এবং তারা তখনই সন্তান গ্রহণ করে, যখন তারা এর জন্য আর্থিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে। ‘মুখ দিয়েছেন যিনি, আহারও দিবেন তিনি’র মতো আজগুবি ধর্মীয় মতবাদের ওপর তাদের কোন আস্থা থাকে না।
সার্বিকভাবে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের সাথে ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় শিক্ষা ও রীতি-নীতির তুলনা করলেই বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যায়ঃ
ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে:
“পুরুষেরা নারীদের অভিভাবক। কারণ, আল্লাহ তাদের একের উপর অপরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং পুরুষেরা নিজেদের ধন-সম্পদ থেকে ব্যয় করে। সতী-সাধবী স্ত্রীরা অনুগত ও বিনম্র। স্বামীর অনুপস্থিতিতে তারা তাঁর অধিকার ও গোপন বিষয় রক্ষা করে। আল্লাহই গোপনীয় বিষয় গোপন রাখেন। যদি স্ত্রীদের অবাধ্যতার আশংকা কর তবে প্রথমে তাদের সৎ উপদেশ দাও। এরপর তাদের শয্যা থেকে পৃথক কর। এরপর যদি তারা তোমাদের অনুগত না হয় তাহলে প্রহার কর।
“নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী দুই-দুই, তিন-তিন, চার-চার রমনীকে বিবাহ কর, কিন্তু তোমরা যদি আশংকা কর যে সমতা রক্ষা করতে পারিবে না, তদবস্থায় একই স্ত্রী কিংবা তোমাদের অধীনস্ত দাসী; ইহা অবিচার না হওয়ারই অতি নিকটতর।”
(কোরান, সুরা বাক্কারাহ, আয়াত- ২২৩):
“ তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত্র, সুতরাং তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যে প্রকারে ইচ্ছা অবতীর্ণ হও।“
হিন্দু/সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে:
“শৈশবকালে নারী পিতার, যৌবনে স্বামীর আর বার্ধক্যে পুত্রের অধিনস্ত থাকবে। নারীরা কখনই স্বাধীন হতে পারবেনা। এমনকী তারা স্বাধীন হওয়ার যোগ্যই নয়।“
(মনুসংহিতা, ৫/১৪৮, ৯/৩)
“আমাকে (ভগবান শ্রী কৃষ্ণ) আশ্রয় করে স্ত্রী, বৈশ্য, শূদ্র এসব পাপযোনিরাও পরম গতি লাভ করে।“
(গীতা, ৯/৪১)
খ্রিস্ট্রিয় ধর্মমতে:
“বিয়ের পর যদি কোন নারীর মধ্যে কুমারীত্বের চিহ্ন না পাওয়া যায় তাহলে সেই নারীকে তার পিতার বাড়ির সামনে সকলে মিলে পাথর মেরে হত্যা করতে হবে।“
(বাইবেল, Deuteronomy ২২:২০-২১)
“স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের প্রতি আত্মসমর্পণ করবে, যেমন গডের প্রতি তারা আত্মসমর্পণ করে।“
(বাইবেল, Ephesians ৫:২২)
বৌদ্ধধর্মে বলা হয়েছে:
“নারী হল উন্মুক্ত মলভাণ্ডের ন্যায়। উন্মুক্ত মলভান্ড দেখিলে মাছি সেখানে ঝাঁপ দিবেই, তাকে রোহিত করা কষ্টকর। কিন্তু একজন জ্ঞানী মানুষ সবসময় এই মলভাণ্ডের দুর্গন্ধ উপলব্ধি করে তা এড়িয়ে চলে।“
(কুণাল জাতক, ৫৩৬ নম্বর জাতক)
একজন ধর্মপ্রাণ ইহুদি পুরুষ তার দৈনন্দিন প্রার্থনায় তাকে একজন মহিলা বা একজন কৃতদাস হিসেবে তৈরি না করার এজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায়।
অথচ মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রে আছে ভ্রার্তৃত্ব ও স্বাধীনতার জয়গান। যেখানে ধর্ম নারীদের পুরুষের অনুগত ও যৌনদাসীতে পরিণত করেছে, সেখানে মানবাধিকার আইন বলে-
“সকল মানুষই স্বাধীনভাবে সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাদের বিবেক এবং বুদ্ধি আছে; সুতরাং সকলেরই একে অপরের প্রতি ভ্রার্তৃত্বসুলভ মনোভাব নিয়ে আচরণ করা উচিত।“
(অনুচ্ছেদ-১)
“যে কোন প্রকার পার্থক্য যথা- জাতি, গোত্র, বর্ণ, নারী-পুরুষ, ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক বা অন্য মতবাদ, জাতীয় বা সামাজিক উৎপত্তি, সম্পত্তি, জন্ম বা অন্য মর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেকেই ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত সকল অধিকার বা স্বাধীকারে স্বত্ত্ববান।“
(অনুচ্ছেদ-২)
“প্রত্যেকেরই জীবনধারণ, স্বধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার আছে।“
(অনুচ্ছেদ-৩)
কোন ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষিত সমাজে নারীদেরকে কখনই পুরুষের দাসী হিসেবে ব্যবহার বা তাদের সম্পর্কে সেরকম ধারণাও পোষণ করা হয়না এবং কেউ সেটা করলেও তার জন্য রয়েছে কঠোর আইন। কোন নারীকে ডাইনী-বুড়ি, ব্যাভিচারিণী, অপয়া, অসতী, সতী ইত্যাদির দোহাই দিয়ে কখনো পাথর ছুঁড়ে বা পুড়িয়ে মারা হয় না। অথচ ধর্মান্ধ দেশগুলোতে অহরহই এসবের নজির পাওয়া যায়।
এই হলো ধার্মিক সমাজ ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের মধ্যকার পার্থক্য।
এখন কথা উঠতে পারে যে, ধর্ম তো নারীদের সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। সকল ধর্মের লোকেরা মূলত সেরকমটাই দাবি করে থাকে। কিন্তু এই দাবিগুলো অনেকটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতোই ধর্মের নোংরামিগুলো ঢেকে রাখার এক নোংড়া অপচেষ্টা মাত্র।
অবশ্যই সকল ধর্মের অনেক গ্রন্থেই নারী-পুরুষের সম-অধিকারের পক্ষে কিছু কথা কাগজে-কলমে উল্লেখ আছে। কিন্তু তা সবসময়ই বাতিল বা ধার্মিকদের দ্বারা অগ্রাহ্য হয়ে এসেছে। বাস্তবজীবনে কখনোই সেগুলি প্রয়োগ বা চর্চা করা হয় নি।
অবশ্যই এমন অনেক ধার্মিক ব্যক্তি আছেন যাঁরা নারী অধিকারকে সমর্থন করে যেমন অনেক ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিরাও নারী-পুরুষের সম-অধিকারের বিপক্ষে। কিন্তু এই ব্যতিক্রমটা এতোটাই নগণ্য পরিমাণের যে, তাকে কখনই উদাহরণ বা পরিসংখ্যান হিসেবে টানা যায় না। তাছাড়া তর্কের খাতিরে যদি এই বিষয়গুলোকে আমরা মেনেও নেই তবুও আমাদের এসব ভুললে চলবেনা যে-
১) প্রত্যেক ধর্মেই মৌলবাদী ও পুরাতন সংস্করণগুলো নারীর জন্য সবচেয়ে বেশি নিপীড়নমূলক ও নারীর স্বাভাবিক জীবনে বাধা সৃষ্টিকারক।
২) ধর্মান্ধ নারী-পুরুষদের তূলনায় গড়ে ধর্মনিরপেক্ষ নারী-পুরুষদের মধ্যে নারী অধিকার ও সমতার সমর্থন করার প্রবণতা অনেক বেশি।
৩) প্রত্যেক ধর্মান্ধ সমাজেই নারীর পোশাকের ব্যাপারে রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা।
৪) ধর্মান্ধ দেশগুলোতে বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন, এসিড নিক্ষেপসহ এহেন কোন অপরাধ নেই যা করা হয় না।
৫) সেসব দেশের আইনসমূহ সর্বদাই পুরুষতান্ত্রিক বা পুরুষদের সুবিধার্থে তৈরি করা।
সুতরাং, সার্বিক দিক পর্যালোচনা করলে বিনা দ্বিধায় বলা যায় যে, নারীর ক্ষমতায়নে ধর্মনিরপেক্ষতার চেয়ে বড় ও সহায়ক কোন বন্ধু হতে পারে না।
শুরুতেই বলেছিলাম, মানুষের জ্ঞানের সীমাদ্ধতা থেকে ঈশ্বর ও ধর্মের সৃষ্টি, আর সেই ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে ও ধর্মের ভাইরাস ছড়িয়ে পৃথিবীর যাবতীয় অপরাধ, বৈষম্যগুলো ঘটানো হচ্ছে। তাই নারীমুক্তির জন্য প্রথমেই আমাদের ধর্মের বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে এসে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে এবং অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে। তা না হলে নারী-পুরুষ উভয়ের মন থেকে নারীবিদ্বেষ দূর করা এবং নারীর জাগরণ কখনই সম্ভব নয়।