অধ্যায় ছয়
ফজলুল করিম এর প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তি
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিনের অবসর নেবার নির্ধারিত সময় ছিল ২২ শে ডিসেম্বর, ২০০৯। তিনি জ্যেষ্ঠতার ক্রমে বিচারপতি মোঃ. তোফাজ্জল ইসলাম ও মোঃ. ফজলুল করিমকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। মোঃ. তোফাজ্জল ইসলাম ১৭ তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০০৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর শপথ গ্রহণ করেন এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০ এ অবসর গ্রহণ করেন। দুই মাসেরও কম সময়ের জন্য তিনি অফিসে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানিতে অংশ নেবার কারণেই মূলত তিনি প্রধান বিচারপতি হন। তিনিও মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে অতিক্রম করে গিয়েছিলেন, যিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হয়ে ওঠেন স্বাভাবিক নিয়মেই। তাঁর পক্ষে একমাত্র ইতিবাচক দিকটি ছিল, তিনি হাইকোর্ট বিভাগের তৃতীয় বিচারক ছিলেন যিনি মোঃ রুহুল আমিন ও খায়রুল হকের দেয়া বিতর্কিত রায়ের পর দুই বা তিনজন আসামীর প্রধান আপিলের পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিলের শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চিন্তাধারার লাইনের বিরুদ্ধে আপিল শুনানির জন্য মোঃ. ফজলুল করিমকে তৃতীয় বিচারকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রধান বিচারপতির অফিস দীর্ঘ সময়ের জন্য রাজনৈতিক পদ হয়ে ওঠে আর এটা মোটামুটি ভাবে কল্পনাতীত হয়ে যায় যে রাজনৈতিক চিন্তাধারার বাইরে কেউ প্রধান বিচারপতি হতে পারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও তার (মোঃ ফজলুল করিম) নাম বিবেচনা করা হয়নি কারণ তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার মামলার আপিল শুনানি করেন। এম. এম. রুহুল আমিন, যিনি বয়ঃকনিষ্ঠ ছিলেন, তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়। ফজলুল করিমকে দুইবার জ্যেষ্ঠতা ভঙ্গ করে অতিক্রম করার পরও তিনি বিচার বিভাগীয় কাজ চালিয়ে যেতে দৃঢ় ও অধ্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর একমাত্র ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হওয়া, কারণ তার শ্বশুর বিচারপতি ইমাম উদ্দিনও ছিলেন একজন প্রধান বিচারপতি। তিনি স্বর্গ-মর্ত্য এক করে ফেলেছিলেন আঠারোতম প্রধান বিচারপতি হবার জন্য। অন্য দিকে, বিচারপতি তোফাজ্জল ইসলামের অবসর নেওয়ার পর এবিএম. খায়রুল হকও প্রধান বিচারপতি হতে চাইলেন। তিনি আপিল বিভাগে মাত্র কয়েক মাস কাজ করেছিলেন কারণ ২০০৩ সালের জুলাই মাসে তিনি আমার মতই পদোন্নতি পেয়েছিলেন। তার পক্ষে এই দিকটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল যে তিনি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় প্রদান করেছিলেন।
মোঃ. ফজলুল করিম ছিলেন ব্যারিস্টার, যেমনটা ছিলেন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ। তাদের মধ্যে একটা বিশেষ সম্পর্ক ছিল, কিন্তু নির্বাচন প্রক্রিয়ার সামান্য ক্ষমতা ছিল শফিক আহমেদের আর প্রধানমন্ত্রীর একারই এখতিয়ার ছিল এই বিষয়ে যদিও সংবিধানের মোতাবেক প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত। এমনকি এক পর্যায়ে, মোহাম্মদ ফজলুল করিম তার নির্বাচনে আমার সাহায্যের জন্য দুবার বাসায় এসেছিলেন। মোহাম্মদ ফজলুল করিমের পক্ষে যতটুকু প্রচারণা চালানো যায় তাই সবটাই হচ্ছিল। অবশেষে, চট্টগ্রামের একজন শক্তিশালী সাংসদ প্রয়াত আখতারুজ্জামান বাবুকে তার পক্ষে তদবিরের জন্য রাজি করাতে সক্ষম হন। চট্টলাবাসী বলে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় সত্ত্বেও একই এলাকার লোক হিসেবে তাদের একে অপরের জন্য একটা বোঝাপড়া ছিল। মোঃ. ফজলুল করিমের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাস অর্জনে আখতারুজ্জামান সফল হন। সরকার একটি দ্বিধা বিভক্ত অবস্থায় ছিল; একদিকে এবিএম. খায়রুল হক ছিলেন আপীল বিভাগের খুব কনিষ্ঠ একজন বিচারক এবং অন্যদিকে মোঃ. ফজলুল করিম তার তদবির নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছেছেন আখতারুজ্জামানের মাধ্যমে। যদিও খায়রুল হকের চেয়ে অন্য দুইজন বিচারক সিনিয়র ছিলেন তবে তারা বিবেচনায় ছিলেন না।
শেষমুহুর্তে আইনমন্ত্রী আর আমার টেলিফোনে আলোচনা হয়েছিল। সেইদিন সন্ধ্যাবেলায় আমি ফজলুল করিমকে বলেছিলাম যে রাতটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, আজই পরবর্তী প্রধান বিচারপতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাকে বললাম, রাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে আমি তাকে জানাব। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঠিক আগেই শফিক আহমেদ আমাকে রাত প্রায় এগারোটার দিকে ফোন করেন, তিনি যদি প্রধান বিচারপতি হিসাবে নির্বাচিত হন তবে সরকারকে বিব্রত করবেন না; এই বিষয়ে মোহাম্মদ ফজলুল করিমের কাছ থেকে আশ্বাস পাবার জন্য। তাড়াহুড়ো করে আমি ফজলুল করিমের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম প্রায় সাড়ে এগারোটায় আর তাকে স্ত্রীর সাথে ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে দেখলাম। ইতিবাচক সংবাদ জেনে তিনি অবশ্যই খুব খুশি ছিলেন। আমি ফজলুল করিমকে আইনমন্ত্রী মেসেজের কথা জানিয়েছিলাম। তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন কিন্তু আমার ঘরে ঢোকবার মুহূর্তে তিনি এত উদ্বিগ্ন ছিলেন যে লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। আমি তাকে দাঁড়াতে বলিনি। তিনি আমার ডান হাত ধরে বললেন, “সবসময় তোমাকে ছোট ভাইয়ের মত দেখতাম। তুমি যা করতে বলবে আমি তাই করব।” তার কথা শুনে অবাক হলাম আর উদ্বেগ প্রকাশ করে বললাম, পদের জন্য নিজেকে ছোট করা তার মত একজন উচ্চ মর্যাদার লোকের পক্ষে শোভন নয়। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি ফজলুল করিমের উদ্দেশ্যে আইনমন্ত্রীর শঙ্কার কথা জানালাম আর আইনমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে ফজলুল করিমের হাতে ফোনটা দিলাম।
এভাবে বিচারপতি মোঃ ফজলুল করিম বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি কয়েকজন আইনজীবীকে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে পদোন্নতি দেবার জন্য সুপারিশ করেন যাদের মধ্যে ছিলেন মোঃ রুহুল কুদ্দুস ও খসরুজ্জামান। তবে নাম প্রকাশের পরপরই, পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নকালে মোঃ রুহুল কুদ্দুস এবং খসরুজ্জামান উভয়েরই ফৌজদারি মামলা ছিল যখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। মূলত সেগুলো রাজনৈতিক ঘটনা ছিল। তারপরেও প্রধান বিচারপতি শপথ নেওয়ার জন্য এই বিচারকদের আমন্ত্রণ জানাননি। এটি ছিল এক বিব্রতকর পরিস্থিতি, আমার, আইনমন্ত্রী, সরকার ও অন্যান্যদের যারা তাকে প্রধান বিচারপতি হিসাবে সুপারিশ করেছিলেন। সরকার এই ঘটনায় অসন্তুষ্ট হয়। কয়েকদিন পরে কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি দ্বারা আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার গেলাম আমি ও প্রধান বিচারপতি করিম সহ বিচারপতিদের একটি দল। অনুষ্ঠানের পরিচিতিমূলক অনুষ্ঠানের পর, একটা জরুরি বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনার জন্য প্রধান বিচারপতিকে আমার ঘরে আমন্ত্রণ জানালাম। আমি প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে অনুরোধ জানাই এবং ওই দুই বিচারককে নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে যেন আমাদের উদ্ধার করেন। তাকে সেই রাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম যখন তিনি কথা দিয়েছিলেন আর যেহেতু কারণ ওই নাম দুটির প্রতি সুপারিশ তার তরফ থেকেই হয়েছিল। প্রধান বিচারপতি তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে অস্বীকার করেন। তারপরও, সরকারের সঙ্গে তার সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। তিনি প্রায় সাত মাস এবং একুশ দিনের জন্য অফিসে ছিলেন। ওই দুই বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক দায়িত্ব গ্রহণের পর শপথ গ্রহণ করেন। তিনি দায়িত্বভার লাভ করেন ৩০ নভেম্বর, ২০১০ এ, বিচারপতি এম এ মতিন ও শাহ মমিনুর রহমানকে জ্যেষ্ঠতার ক্রমে অতিক্রম করে। ১৭ মে, ২০১১ তারিখে খায়রুল হক অবসরপ্রাপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত উভয়ই পদত্যাগ করার পরিবর্তে দীর্ঘ ছুটি গ্রহণ করেন। এরপর ১৮ মে, ২০১১ তারিখে মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেনকে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করা হয়, আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে জ্যেষ্ঠতার ক্রমে অতিক্রম করে। এর পরপরই, তিনি পদত্যাগ করেন।
খাইরুল হক যখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন তখন আপীল বিভাগের জনবল হ্রাস পেয়ে মাত্র তিন সদস্যে এসে ঠেকেছিল: প্রধান বিচারপতি ছাড়া মোঃ মোজাম্মেল হোসেন ও আমি ছিলাম। মোঃ আবদুল ওয়াহাব মিয়াকে এড়াতে সরকার এ পদ পূরণে বিচারপতি নিয়োগে বিলম্ব করে। আদালতে প্রচুর চাপ ছিল এবং কাজের ভার মাত্র তিনজন বিচারকের পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিল না। এ সময় আবদুল ওয়াহাব মিয়া হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক ছিলেন। সরকার তাকে আপিল বিভাগে উন্নীত করতে অনিচ্ছুক ছিল। এরকম একটা ধারণা ছিল যে, অন্য কনিষ্ঠ বিচারক নিয়োগ করা হলে সুপ্রিম কোর্টের বারে এক ধরণের চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হতে পারে কারণ তিনি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে যুক্ত ছিলেন না এবং বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তিনি বারের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন এবং সুপ্রিম কোর্ট বার বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল ও মোঃ আবদুল ওয়াহাব মিয়া তাদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি বার সমিতির সেক্রেটারি ছিলেন দুবার। পদোন্নতির জন্য তিনি দৃঢ়ভাবে তদবির করছিলেন। এমনকি এক পর্যায়ে তিনি খোলা আদালতে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন আর সেটা বার অ্যাসোসিয়েশন ও বিচারকদের কক্ষে সেদিন আলাপের বিষয় হিসেবে ছিল তুঙ্গে।
তিনি এত উচ্চাভিলাষী ছিলেন যে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে উন্নীত হওয়ার দিন থেকে প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখতেন এবং তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের এক অনুষ্ঠানে আমার উপস্থিতিতেই এই অভিপ্রায় প্রকাশ করেছিলেন। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল আইনজীবীদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করছিল। অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। প্রাক্তন ও বর্তমান বিচারপতি ও সিনিয়র আইনজীবীগণ ক্লাস পরিচালনা করতেন। একদিন অমায়িক ও সুশৃঙ্খল স্বভাবের বিচারক, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এম সাদেক অপেক্ষা করছিলেন বিচারকদের কক্ষে। সে সময় সাদেক আব্দুল ওয়াহাব মিয়া ও আমার কাছে বিচার সংক্রান্ত কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলেন এবং প্রশংসা করলেন এই বলে যে, আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে এবং বিচার বিভাগে আমরা আরও অবদান রাখতে সক্ষম হব। আবদুল ওয়াহাব মিয়া বলেন, যদি আল্লাহ না করেন, তবে বিচারপতি সিনহা তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রধান বিচারপতি থাকবেন আর তিনি এগারো মাসের জন্য প্রধান বিচারপতি হবেন। যদিও তিনি সুপ্রিম কোর্টে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে তিনি আমার সিনিয়র ছিলেন, কিন্তু বয়সের জ্যেষ্ঠতার কারণে আমাকে পদোন্নতির সময় জ্যেষ্ঠতা দেয়া হয়। আমি মোঃ আব্দুল ওয়াহাব মিয়াকে আগে থেকেই জানতাম, তাই সে যে ধারনা দিতে কথাটি বলেছিল, তা আমার কাছে পরিষ্কার ছিল আর আমি মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকি।
ওবায়দুল হাসান ও এম এনায়েতুর রহিম ছিলেন আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার চেয়ে কনিষ্ঠ, যখন তারা বারে অনুশীলন করতেন। সৈয়দ রেজাউর রহমানের সঙ্গে তারা জাতীয় আইনজীবী সমিতিতে যুক্ত ছিলেন, যা কিনা এডভোকেট খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি বিকল্প আইনজীবী ফোরাম। শামসুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে সমন্বিত আইনজীবী সমিতি ছিল এই ধরণের বৃহত্তম ফোরাম। স্বাভাবিকভাবেই ওবায়দুল হাসান ও এনায়েতুর রহিমের সাথে বোঝাপড়া ও ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্ক ছিল আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার। এই দুই বিচারক আপিল বিভাগে তাদের জ্যেষ্ঠ বিচারকদের কাছে বারবার ঘুরতে আসতেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও তারা আমার চেম্বারে আসতেন আর শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর, জিজ্ঞেস করতাম জরুরী কোন কাজ আছে কিনা। তাদের আসার উদ্দেশ্য জানতাম কিন্তু কিছুই না জানার ভান করতাম। তারা জানতেন যে আমি খুব কঠোর ব্যক্তিত্ব এবং কখনো তারা বিষয়টি উত্থাপনের সাহস দেখাননি। তারা অভ্যাসবশতই বলতেন; “স্যার, আমরা আপনাকে সালাম জানাতে এসেছি।”
এক সপ্তাহান্তের সকালে মাহবুবে আলম একটি ব্যক্তিগত বিষয়ে আলোচনার জন্য কাকরাইলে আমার সরকারি বাসভবনে আসেন। আমাদের মধ্যে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার কারণে তখন সম্পর্ক ভাল ছিল। তিনি একেবারেই প্রগতিশীল মানসিকতার লোক আর রবীন্দ্র সংগীতের ব্যাপারে দুর্বল। মাঝে মাঝে নির্বাচিত দর্শকদের জন্য ভারতীয় গায়কদের আমন্ত্রণ জানিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজনও করেছেন। আবদুল ওয়াহাব মিয়া কল্পনাও করতে পারেননি যে অ্যাটর্নি জেনারেল আমার বাসভবনে থাকবেন এবং তাকে দেখে ওয়াহাব মিয়াকে কিছুটা বিব্রত বোধ করতে দেখলাম। মাহবুবে আলম ও আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার মধ্যে সম্পর্ক ভালোই ছিল, কিন্তু তাদের ভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার কারণে পরস্পরের মাঝে কিছুটা দূরত্ব থাকত। যদিও দেখা হলে একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতই আচরণ করতেন। এই ধরনের দৃষ্টিবিনিময় আমার কাছে বেশ বিনম্র বলেই মনে হত আর আমি তাদের পরস্পরের সাথে দেখা যখন মুহূর্তটা উপভোগ করতাম। আগের বর্ণনা মতে, মাহবুবে আলম ছিলেন একজন প্রগতিশীল ব্যক্তি, যদিও আব্দুল ওয়াহাব মিয়া নিজেকে প্রগতিশীল দাবি করতেন, তবে তার কাজ ও আচরণ অন্যকিছুর প্রমাণ দিত। ওবায়দুল হাসান ও এনায়েতুর রহিম সবকিছু জানার পরও আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেছিলেন এবং তাঁর পদোন্নতির ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলেন।
যাই হোক, ওবায়দুল হাসান ও এনায়েতুর রহিম উভয়ই শক্ত আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ পরিবার থেকে উঠে আসা ছিলেন। ওবায়দুল হাসানের ছোট ভাই সাজ্জাদ একজন অতিরিক্ত সচিব, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কাজ করছেন আর তার খুব ঘনিষ্ঠ। এনায়েতুর রহিমের ছোট ভাই ছিলেন আওয়ামী সংখ্যাধিক্যের সংসদে লীগ সরকারের হুইপ। আমার বাসভবনে আসার ব্যাপারে আবদুল ওয়াহাব মিয়ার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিলাম আর তাকে আমাদের সাথে চা খেতে অনুরোধ করলাম। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের উপস্থিতিতে ইতস্তত হয়ে বললেন, আমরা গোপন কিছু আলোচনা করছি; এখন তার উপস্থিতি যথাযথ নয়। চা পানের পর, ওয়াহাব মিয়া চলে যেতে চাইলেন কিন্তু আমি চেম্বার থেকে বেরিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলকে কিছুক্ষণ অপেক্ষার অনুরোধ করলাম। বারান্দার বাইরে আবদুল ওয়াহাব মিয়া আমাকে ধরে বললেন, বন্ধু, আমাকে ক্ষমা করে দিন, যদি আপনাকে অসন্তুষ্ট করে থাকি। উচ্চতর বেঞ্চে উন্নীত হতে আমাকে দয়া করে সাহায্য করুন।”
এই প্রথমবার তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন আর ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু আমি তাকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করেছি বললাম আর আপীল বিভাগে উন্নীত হলে খুশি হব ও তার পথে বাঁধা হব না। এই আশ্বাস পেয়ে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেন। যখন অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে ফিরলাম তখন মাহবুবে আলম স্বাভাবিক ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করলেন আব্দুল ওয়াহাব মিয়া পদোন্নতির জন্য তদ্বিরে এসেছেন কিনা। আমি হাসলাম। তখন মাহবুবে আলম বলেন, “এই ভদ্রলোক হাইকোর্ট বিভাগকে দূষিত করে ভুল করেছে আর তাকে পদোন্নতি দেয়া হলে প্রশাসনের ন্যায়বিচারে গুরুতর জটিলতা থাকবে।”
অবশেষে আব্দুল ওয়াহাব মিয়া তাঁর নাম নাজমুন আরা সুলতানা, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, মুহাম্মদ ইমাম আলী ও হাসান আব্দুল ফয়েজ সিদ্দিকীদের সাথে পদোন্নতির জন্য যুক্ত করতে সক্ষম হন। বাকি তিন বিচারক তার চেয়ে অনেক কম বয়সী ছিলেন। পরবর্তীতে, প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার একবার দেখা করার উপলক্ষ ছিল আর বিচার বিভাগ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। এক পর্যায়ে তিনি বললেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কারণে মোঃ আবদুল ওয়াহাব মিয়াকে নিয়োগের জন্য তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। পরে জানতে পারলাম, ওয়াহাব মিয়া আইনমন্ত্রীর সাথে দেখা করেছিলেন আর তাকে কোনভাবে পদোন্নতির বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তদবির করতে সম্মত করতে পেরেছিলেন। আনিসুল হক পরবর্তীতে আমার কাছে স্বীকার করেন, তিনি ভুল করেছেন আর এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অনেক সমালোচনা শুনেছেন।
অনেক সময়ই আমাকে প্রধান বিচারপতির কাজগুলো করতে হত যেহেতু প্রধান বিচারপতি কেবল ছুটির সময়ই নয় বরং নিয়মিত আদালতের সময়ও ভ্রমণ করতেন। এরকমই এক সময়ে, যখন আমি ভারপ্রাপ্ত ছিলাম, তখন ফারুক আহমেদের দুর্নীতির বিষয়ে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ লক্ষ্য করি। রিপোর্টে তার বিরুদ্ধে কেসের সংখ্যাও বলা হয়েছিল। কয়েকদিন আগে ফারুক আহমেদ বিশেষ জজ হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। অভিযোগ করা হয়েছে, অবসর নেওয়ার আগে গত ছয় মাসে তিনি গুরুতর দুর্নীতি করেন। খবর পড়ার পরই আমি আদালত পরিদর্শন করতে গেলাম। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা কিছু মামলার নথি পরিদর্শন করি এবং লক্ষ্য করি যে উক্ত বিচারক একদিনে দুই বা একাধিক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছিলেন। তিনি সাক্ষীদের উপস্থিতির নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করেননি এবং অন্যের আগমনের অপেক্ষা না করে এক বা দুই সাক্ষীকে পরীক্ষা করেই সাক্ষ্য নেয়া বন্ধ করেন, প্রসিকিউশন বন্ধ করেন আর অভিযুক্তদের খালাসের সিদ্ধান্ত দেন। আমি দুই মাসের বিচারিক রেকর্ড খুঁজে দেখেছি আর দুই মাসে তিনি প্রায় একশত মামলা নিষ্পত্তি করেছিলেন, যার বেশিরভাগই সোনা বা মূল্যবান পণ্যের চোরাচালান সংক্রান্ত বিষয়। বেঞ্চের সহকারী ও আইনজীবীদের তদন্তে প্রকাশ পায় পাবলিক প্রসিকিউটরদের কাজের অসংলগ্নতা। তাছাড়া, পাবলিক প্রসিকিউটরদের সহায়তা ছাড়া তিনি এধরণের রায় প্রদান করতে পারতেন না। আমি বেঞ্চ সহকারী ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেই, মামলার রেকর্ড ছাপানোর জন্য একটা প্রিন্টার আনতে, যাতে সেদিনই রিপোর্টটা জমা দিতে পারি কারণ পরের দিন প্রধান বিচারপতি তার কাজ পুনরায় শুরু করবেন।
লক্ষ্য করলাম যে, শুনানির জন্য প্রস্তুত নয় এমন মামলার ক্ষেত্রে তিনি চার্জ গঠন করেন আর পরবর্তী দিনটি বিচারের জন্য স্থির করেন এবং একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেবার পরই তিনি মামলার শুনানি বন্ধ করে দেন আর রায় প্রদান করেন। সমস্ত দলিল দস্তাবেজ আনার পর, আমি রাতে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনে বসেছিলাম এবং রিপোর্টটি লিখিয়ে নিচ্ছিলাম। রিপোর্টটি চূড়ান্ত করতে করতে প্রায় রাত দশটা বেজে যায় এবং আমার ফিরে আসা পর্যন্ত রেজিস্ট্রারকে অফিস খুলে রাখতে নির্দেশ দেই। বিপুল পরিমাণ চোরাচালান ও দুর্নীতির মামলা দায়ের করতে কর্মকর্তারা অবিশ্বাস্য রকম দুর্নীতি ও জালিয়াতি করে। অফিসার অবসর নেওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে এবং মন্ত্রণালয়ের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত পেনশন সুবিধা না দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে আমি একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করি। আমি আরও উল্লেখ করেছিলাম যে সময়ের অভাবের কারণে অন্যান্য মামলাগুলির নথিপত্র দেখা সম্ভব হয়নি এবং গত দুই মাসে ফারুক আহমেদের শুনানি সম্পর্কিত বিষয়গুলো হাইকোর্ট বিভাগের অন্য আরেকজন বিচারককে দিয়ে তদন্ত করার জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে অনুরোধ জানাই। এই সংবাদটি কোনভাবে প্রচার মাধ্যমের কাছে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরের দিন প্রকাশিত হয়। প্রধান বিচারপতি পরদিন আমার কাছে জানতে চাইলেন, কেন তার জন্য অপেক্ষা না করে রিপোর্ট জমা দিয়েছি আর আমাকে তৎক্ষণাৎ রিপোর্টটি প্রত্যাহার করার জন্য বললেন। আমি তাকে জানালাম, আমি কেবলমাত্র যে অনিয়ম খুঁজে পেয়েছি তা নির্দেশ করেছি আর এই ধরনের বিচারককে বরদাস্ত করা যায় না। তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে মন্ত্রণালয় ও দুদকের সাথে যোগাযোগ না করে রিপোর্ট গোপন রাখতে পারেন বা অন্যথায় তার ক্ষমতা প্রয়োগে প্রতিবেদন প্রত্যাহার করতে পারেন। কিন্তু আমি জমা দেওয়ার পর রিপোর্ট প্রত্যাহার করতে পারিনি।
এই কর্মকর্তা দুর্নীতিগ্রস্ত বলে পরিচিত ছিলেন আর তাঁর নাম তিনবার প্রস্তাব করা হয় মন্ত্রণালয় ও জিএ কমিটি কর্তৃক, যা কিনা প্রধান বিচারপতি এবং হাইকোর্ট বিভাগের তিন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির নেতৃত্বে সর্বোচ্চ সংস্থা। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের স্থানান্তর ও পোস্টিং বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী দাবির কারণে প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য প্রধান বিচারপতি কমিটির সদস্যদের ওপর চাপ প্রয়োগ করলেও তারা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ওই কর্মকর্তা ব্যক্তিটি কিশোরগঞ্জ থেকে এসেছিলেন এবং প্রধান বিচারপতিও একই এলাকার ছিলেন। কিন্তু বিচারকরা এই প্রস্তাব অনুমোদনকে প্রত্যাখ্যান করেন। এক পর্যায়ে ফারুক আহমেদকে ঢাকায় পোস্টিং করার বিষয়ে প্রধান বিচারপতি জোর দেয়ায় এক বিচারক কমিটি থেকে পদত্যাগের হুমকি দেন। এরপর প্রধান বিচারপতি জিএ কমিটির পুনর্গঠন করেন এবং প্রস্তাব অনুমোদন করেন। যখন বিষয়টি আইনমন্ত্রীর নজরে আনা হয়, তখন তিনি কোন মন্তব্য করেননি। অন্য আরেকজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা সম্পর্কে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিভাবে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা রায় প্রদানের পর দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারেন আর কেমন করে বিদেশে ভালোভাবে থাকতে পারেন। তাকে বলেছিলাম এ বিষয়ে তার আইন সচিবকে জিজ্ঞাসা করা ভালো হবে কারণ বিষয়টা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিতে আনা হয়েছিল। এই ধরণের অসংখ্য ঘটনা ঘটে ছিল আদালতে।
সাধারণত আমি আইনজীবীদের অপ্রাসঙ্গিক নথিভুক্তি করবার অনুমতি দেই না আর কোনও বিষয়ে শুনানির সময়ে আইনজীবীদের সময়ক্ষেপণ একদম সহ্য করতে পারি না। আমি সবসময় আদালতের সময় নষ্ট না করে মামলা নিষ্পত্তি নিষ্পত্তি পছন্দ করি কিন্তু কিছু বিচারকের পরিষ্কার সারসংক্ষেপ করা নিবন্ধ তৈরিতে আগ্রহ নেই; বরং তারা যেন আইনজীবীদের সুখী করতে পারলেই আনন্দিত হন এবং অপ্রাসঙ্গিক নথিভুক্তির অনুমতি দেন। একবার যখন আমি বেঞ্চে সভাপতিত্ব করছিলাম, দেখেছি যে একজন আইনজীবী অপ্রাসঙ্গিক নথি জমা দেন এবং মোঃ আবদুল ওয়াহাব মিয়া আইনজীবীর জমা দেওয়ার বিষয় নিয়ে আলাপ দীর্ঘায়িত করার জন্য তা নিয়ে প্রশ্ন করছিলেন।
কোন উপায়ন্তর না পেয়ে আমি হস্তক্ষেপ করলাম আর মামলার সাথে সম্পর্কিত আইন বিষয়ে প্রশ্ন উত্তর দিতে আইনজীবীকে আদেশ দিলাম। হঠাৎ বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিয়া আদালত প্রাঙ্গণে চিৎকার করে ওঠেন, “আমি তাকে সহ্য করতে পারিনা আর তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসার সুযোগ দিচ্ছি না। আমি সবসময় তাকে দমিয়ে রাখি” এই ধরণের অনেক কথা বলছিলেন। প্রকৃতিগত ভাবেই, ওয়াহাব মিয়ার কণ্ঠ ছিল খুব উচ্চকিত। যখন তিনি কারো সাথে কথা বলেন তখন সাধারণ কেউ মনে করতে পারে যে তিনি ঝগড়া করছেন। যখনই বিচারপতি কোন শুনানির সময় কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন, তখন অধস্তন বিচারকগণ কথা বলা বন্ধ করে দেন, এটা আদালতের চিরাচরিত প্রথা। সুতরাং, এভাবেই আদালতের ডেকোরাম রক্ষিত হয়। এটি এমন এক ঐতিহ্য যা শত শত বর্ষ ধরে অনুশীলন করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই, মুক্ত আদালতে আবদুল ওয়াহাব মিয়ার দুর্ব্যবহারের কারণে বিব্রত বোধ করলাম। আমি আদালতে থেকে সরাসরি এসেছিলাম। তাই স্বাভাবিকভাবেই সব বিচারকগণ আমাকে অনুসরণ করছিলেন। চেম্বারে প্রবেশের পর, অন্য বিচারকদের সামনে হাতজোড় করে আবদুল ওয়াহাব মিয়াকে অনুরোধ করলাম, “সব নিয়মকানুন ভঙ্গ করে খোলা আদালতে কোন ধরণের বাজে পরিস্থিতির সৃষ্টি করবেন না” এটি বারে ভুল বার্তা পাঠাবে আরও যোগ করলাম “যদি কোন ভুল করে থাকি তবে শর্তহীন ক্ষমা প্রার্থনা করি। দয়া করে শান্ত হোন এবং আজকের কার্যদিবসে থাকা কাজ শেষ করতে আদালতে বসুন।” বিচারকদের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখা আর বিচারের স্বার্থে আমি পরিস্থিতি শান্ত করেছিলাম। আমি বিশ্বাস করি, ভুল বোঝাবুঝি থাকলেও তা আমাদের বিচার কাজকে প্রভাবিত করা উচিত না।
ওই সময়টাতে, আমি প্রশাসনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার মত যথেষ্ট সৌভাগ্যবান ছিলাম, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইনি দিকগুলোতে আমার দ্রুত উপলব্ধির জন্য সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলাম এবং সেই অনুযায়ী নীতিগত বিষয়গুলিতে প্রধান বিচারপতিকে পাশ কাটিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
চলবে…
=============
নবযুগ সম্পাদকের নোট: তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে দীর্ঘ সামরিক শাসনের ইতিহাস মাথায় রেখে যারা বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করে তারা আসলে কেউই মনে রাখেননা, দিনশেষে তারা সামরিক শাসক নন, জনগণের নির্বাচিত সরকার। পর্দার আড়ালে ঘটে যাওয়া ঘটনা সামনে আসবার নজির খুব কম বলেই, আমরা সম্পূর্ণটা কখনো জানতে পাই না। তাই রূপকথার মতো মনে হয় আমাদের বাস্তবতাগুলো, সেই জাদুবাস্তবতার বাংলাদেশের জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র আত্মজীবনীমূলক বই ‘একটি স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী: আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র’ একটি মোক্ষম চপেটাঘাত, আমাদের ঘুমন্ত নাগরিকদের জেগে ওঠার আহ্বান।
বইটি দ্রুত অনুবাদের জন্য ড. নাজিম উদ্দিন-এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী গবেষক ও লেখক আদিত্য রাহুলকে। আশাকরি অনেকেই বইটি পাঠ করে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে একটা ধারণা পাবেন। এই পর্ব, অর্থাৎ ৬ষ্ঠ অধ্যায় -এর ‘ফজলুল করিম এর প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তি‘ অংশটি অনুবাদ করেছেন আদিত্য রাহুল।
এই বইটি অনুবাদ করতে গিয়ে লেখকের শৈশব ও যুবক বয়সের কিছু গ্রাম ও মানুষের নাম ইংরেজিতে যেভাবে লেখা হয়েছে তার বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ করতে কিছুটা সংশয় হওয়ায়, আগ্রহী পাঠক ও জ্ঞাত ব্যক্তিদের এই বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে অনুরোধ করা যাচ্ছে। গ্রাম ও ব্যক্তির নামগুলো কারো যদি জানা থাকে তবে সেগুলোর সঠিক বানান, জানাবার অনুরোধ রইল। সকলকে শুভেচ্ছা।