১৩১৬ বার পঠিত
১৩১৬ বার পঠিত
‘জঙ্গীবাদ’ শব্দটির উৎপত্তির ব্যাখ্যার পূর্বে যদি ‘জঙ্গী’ শব্দটির খানিকটা ব্যাখ্যা করা যায় তবে তার সাথে ‘বাদ’ জুড়ে দিলে শব্দটির মোটামুটি একটা পরিচিতি পাওয়া যাবে।
উর্দু শব্দ ‘জং’ মানে যুদ্ধ। তার থেকেই এসেছে জঙ্গী শব্দটি। যার বাংলা দাঁড়ায়- ‘যোদ্ধা’।
আবার যুদ্ধ নানাবিধ রকমের। গৃহযুদ্ধ, রাষ্ট্রযুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ, তর্কযুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধ, ইত্যাদি। সেভাবেই রাষ্ট্রের পক্ষে কিংবা রাষ্ট্রের হিতে যিনি শত্রুর সাথে যুদ্ধ করেন তিনি রাষ্ট্রিয় যোদ্ধা বা সৈনিক। সেই বিচারে সেনাবাহিনী হলো যোদ্ধাবাহিনী, রাষ্ট্রীয় জঙ্গিবাহিনী।
ধর্মের জন্য যিনি যুদ্ধ কিংবা জং করেন তিনি হন ধর্মীয় জঙ্গী। আবার ধর্মীয়যুদ্ধের আরবি শব্দ হলো ‘জিহাদ’। সুতরাং ‘ধর্ম-সৈনিক’- এর আরবিয়রূপ ‘জিহাদি’। কোনো সৈনিককে আমরাতো জঙ্গী বলিনা! দেশপ্রেম নিয়ে কেউ যদি সরকার বিরোধী যুদ্ধ করে, তাকে আমরা জঙ্গী বলিনা, বলি বিপ্লবী।
খুব সরল এই ব্যাখ্যায় ‘জঙ্গী’ শব্দটি কী খুব একটা নেতিবাচক মনে হয়? না, মনে হয়না। কিন্তু কেমন করে জং বা যুদ্ধ যে করে, সেই জঙ্গী বর্তমানে ঘৃণ্য পরিচিতিতে চরম কলঙ্কিতরূপে প্রতিভাত হচ্ছে! যুদ্ধবাদ আজ হীন জঙ্গীবাদে রূপান্তরিত হচ্ছে!
এযাবৎ আমরা জঙ্গী আটক, গ্রেফতার ইত্যাদির যতোগুলি সংবাদ লক্ষ করেছি তার অধিকাংশক্ষেত্রেই দেখেছি জঙ্গীদের আস্তানায়, আড্ডায়, ঘরে জিহাদি বই, সিডি, অডিও-ভিস্যুয়াল ম্যাটেরিয়ালের পাশাপাশি অস্ত্র, বোমা ও বিস্ফোরকও পাওয়া গেছে! তার মানে জঙ্গীদের কাছে জিহাদি বই থাকে, এটাই সত্য! অথচ জিহাদি বই-পুস্তক পড়ে ও পড়িয়ে যারা সেই বই-পুস্তকের আদর্শ ছড়ানোর যুদ্ধ করছে তাদের আমরা ‘জিহাদি’ না বলে ‘জঙ্গী’ বলে আখ্যায়িত করছি! এটা হাস্যকর!
ইসলামের পথে মানুষকে আনার জন্য, ইসলামি আইন, আকিদা, শরা-শরিয়ত মতে চলার জন্য এবং যারা সেইমতো চলে না, তাদের হেদায়েতের লক্ষ্যে জিহাদিরা জিহাদ করছে, বেদ্বিন কাফেরদের মেরে ফেলার যুদ্ধে লিপ্ত আছে, তারাতো তাদের ধর্মীয় ফরজ আদায় করছেন! তাদের মনে এই ধর্মস্পৃহা, আকর্ষণ, যোশ এতো তীক্ষ্ণ যে তারা আত্মঘাতি হতেও দ্বিধা করছে না! এটাতো ওরা ইসলাম ধর্মের মৌলিক শিক্ষা থেকেই প্রাপ্ত হয়েছে! এইসব জিহাদিদের নাম দেয়া হচ্ছে ‘জঙ্গী! অথবা বলা হচ্ছে ‘ইসলামের নামে এরা জঙ্গীবাদ কায়েম করছে’!
ইউরোপিয় দেশগুলিতে কিন্তু এদের বলা হচ্ছিল ‘ইসলামি মিলিট্যান্ট গ্রুপ’ কিংবা ‘ইসলামি টেরোরিস্ট গ্রুপ’ ইত্যাদি। হালে তারাও কায়দা করে বলা শুরু করেছে ‘ইন্টারন্যাশনাল টেরোরিস্ট’! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ‘ভাসুরের নাম নেয়া ঠিক নয়, শুধু ভাইজান বলাই ভালো’!
এই লেখাটি যখন লিখছিলাম তখন টিভি চ্যানেলে কাশিমপুর কারাগারের খবর চলছিল। সংবাদ পাঠক হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নানের ফাসি কার্যকরণ প্রস্তুতির বিবরণ দিচ্ছিলেন। বলছিলেন জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানের ফাসি আজ যেকোন সময় কাশিমপুর কারাগারে কার্যকর করার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে…। কিন্তু তার সহযোগী জিহাদিরাতো তাকে ‘জিহাদি নেতা’ বলেই মানে! তার ফাসি হবে, সে ডাইরেক্ট জান্নাতে চলে যাবে, তারাতো তাই ভাবে এবং হয়তো নেতাদের পদাংক অনুসরণের প্রস্তুতি নেয় মনে মনে!
কোরান হাদিস ইত্যাদিতে ধর্ম প্রচার, প্রসার এবং চর্চার যে সকল অসংখ্য বক্তব্য, নির্দেশ, ইঙ্গিত রয়েছে সেগুলো সময়ে সময়ে স্থানবিশেষে অর্থপ্রকাশে নানাভাবে জটিল হয়েছে যে তা ইসলামের ইতিহাসেই আছে। মূল কোরান আংশিক যে মুসলিমদের কাছে আসেনি তা ইতিহাস থেকেই জানা যায়। বিভ্রান্তি ছিল বলেই খলিফা ওমর সেগুলো নিশ্চিহ্ন করেছিলেন! কিন্তু তারপরও বহু বিভ্রান্তি, অপব্যাখ্যা, উদ্দেশ্যমূলক অনুবাদ চলছেই! কিন্তু যা কিছুই হোক না কেন, মৌলিকত্ব না থাকার কোনো কারণ নেই।
সুতরাং মৌলবাদী আছর থেকে মুক্ত থাকার জো নেই। সেক্ষেত্রে বিশ্বের ইসলামি বিশেষজ্ঞদের একটা ঐকমত্য অবস্থানে আসা এখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। ইসলামের নামের সাথে আজ যে কলংক যুক্ত হয়ে পড়েছে তা থেকে ইসলামকে মুক্ত করা তাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
‘ইসলাম অর্থ শান্তি’- এই কথা বলে আজকাল আর শান্তি নেই। প্রকৃত শান্তি স্থাপন করতে হলে মসজিদ মাদ্রাসাগুলোতে নেতিবাচক শিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা, বক্তৃতা, মানবিকতা, সামাজিক কল্যাণ, মানব সভ্যতা, সামাজিক সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি বিষয়ে খুৎবা, আলোচনা, মাহফিল ইত্যাদি চর্চা করতে হবে। এসবই সম্ভব। একসময় ছবি তোলা, ছবি দেখা ইসলামি সমাজে ঘোরতর অপরাধ ছিল। যদিও এখনো প্রত্যন্ত গ্রামে এসব কুসংস্কার আছে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখন ছবি তোলাই শুধু নয়, এখন মসজিদে চলচ্চিত্র ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বড় পর্দার মাধ্যমে প্রদর্শনপূর্বক বয়ান এবং নামাজও চর্চিত হচ্ছে! কাজেই, কোরান থেকেই ব্যাখ্যা নেয়া যেতে পারে; কীভাবে ইসলামকে যুগোপযোগী করে তোলা যায়। ধর্মগ্রন্থগুলো থেকেই ব্যাখ্যা নেয়া যেতে পারে কেমন করে ধর্মীয় মৌলবাদমুক্ত হতে পারে পৃথিবীর মানুষ।
‘যার যার ধর্ম তার তার’ কিংবা ‘ধর্মগামী হওয়া কিংবা না হওয়ার অধিকার যে কোনো মানুষেরই আছে’- এমন চিন্তার বিস্তৃতি হোক বিশ্বব্যাপী। জঙ্গীবাদ নামের আড়ালে চর্চিত জিহাদিবাদ ধ্বংস হোক। ধর্মান্ধতার আহম্মকি থেকে মুক্ত হোক মানুষ এবং মানবতা।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন