০
১২১৯ বার পঠিত
১২১৯ বার পঠিত
আমি একজন নাস্তিক মানুষ। দেবী সরস্বতীর অস্তিত্বে এবং সাধারণভাবে মূর্ত্তি পূজায় আমার তেমন বিশ্বাস না থাকলেও বর্ত্তমান সমাজের বেশীরভাগ মানুষই আস্তিক এবং তারা নানা দেবদেবীতে এবং মূর্ত্তিপূজায় বিশ্বাস করেন। আমি নিজে নাস্তিক হলেও সেইসব আস্তিক মানুষদের অশ্রদ্ধা করি না। সরস্বতী পূজার প্রকৃত তাৎপর্য্য কী তা নিয়ে আমি যা বুঝেছি আস্তিক-নাস্তিক সকল বন্ধুদের জন্য সেকথা সহজ ভাষায় নিবেদন করার চেষ্টা করছি। প্রথমে মৎপ্রণীত পদ্যাভিধান ‘বর্ণসঙ্গীত’ থেকে সরস্বতী শব্দের সূত্র বলি :
”সরস্বতী নামে নদী আছে তাহা জলপ্রবাহ বয়,
দেবী সরস্বতী আসলে সরস জ্ঞানপ্রবাহ হয়।
সে সরসবতী, তাই সরস্বতী, সে দেয় বিদ্যাধন;
তাকে দেবী রূপে ভাবে কবি আর শিল্পী লোকের মন॥”
‘বর্ণসঙ্গীত’, স, পয়ার নং ১৪
ছোটোবেলায় আমার সরস্বতীভক্তি ছিল। তখন আমি নিজেকে নাস্তিক বলতাম না। সেসময় ইস্কুলে সরস্বতী পূজায় আমাদের খুবই আনন্দ হত এবং আমরা শুদ্ধ মনে, ভক্তিভরে সেই পূজা করতাম। ভোরের বেলায় বনে পূজার ফুল তুলতে যেতাম, উপবাস দিয়ে বাড়ীতে সরস্বতী পূজা সেরে তারপর ইস্কুলে পূজা হত। দুপুরে ইস্কুলে খিচুড়ি খাওয়ানো হত, তার আনন্দই ছিল আলাদা। আমাদের গ্রামের হাইস্কুলে (পাঁচাল হাইস্কুলে) কোনো কোনো বছর ছাত্রেরা সরস্বতী পূজায় নাটক করত এবং নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করত। আমরা সেসব খুবই উপভোগ করতাম, মনে পড়ে। তারপর যখন একদিন সরস্বতী পূজায় খিচুড়ি বন্ধ হয়ে প্যাকেট দেওয়া শুরু হয়ে গেল তখন আমাদের খুবই কষ্ট হয়েছিল। এই নিয়ে ছাত্রশিক্ষক মীটিং-এ বছরের পর বছর বিতর্ক হত। অবশ্য তাতে ছাত্রশিক্ষক সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়নি। শিক্ষকদের আমরা খুবই ভয়ভক্তি করতাম।
সরস্বতী বানান ‘সরস্বতী ‘না ‘স্বরসতী’ হবে তা মুখস্থ করতে হত, আমরা কেউ কেউ মাঝে মাঝে বানানটা গুলিয়ে ফেলতাম। স্বর বাাননে স-এ ব-ফলা (স্ব) হয়; সতী, অসতী প্রভৃতি বানানে স-এ ব-ফলা হয় না; তাহলে সরস্বতী বানানের প্রথমাংশে ‘স্বর’ না হয়ে সর এবং পরবর্ত্তী ‘স্বতী’ শব্দাংশে স-এ ব-ফলা (স্ব) হয়ে বানানটি ‘সরস্বতী’ হয় কেন (সরস্বতী বানান ‘স্বরসতী’ হয় না কেন)? এখানে এই প্রশ্নটির উত্তর দেব। এর কারণ হল সরস্বতী কথাটির সঙ্গে স্বর এবং সতী শব্দের সরাসরি সম্পর্ক নাই। সরস্বতী শব্দটি এসেছে সরসবতী শব্দ থেকে (সরসবতী >সরস্বতী)। সরস্বতী একটি নদীর নাম। এ হল বিদ্যার নদী, সরস জ্ঞানের নদী, যা জ্ঞানচর্চ্চা কারী জনগণের মধ্যে সরস জ্ঞানের স্রোতধারা রূপে বর্ত্তমান থাকে। সরস্বতী নামে একটি বাহ্য নদীও আছে যা সর বা জল বহন করে। তবে ‘সরস্বতী’ শব্দটি উচ্চারিত হলে প্রথমে জ্ঞানের নদীকেই প্রত্যক্ষ করতে হবে, জনসমুদ্রের জ্ঞানচর্চ্চাকারী অংশকে দেখতে হবে, ইস্কুলকলেজে ছাত্রশিক্ষকের মধ্যে বিদ্যাপ্রবাহকে দেখতে হবে। সরস্বতী শব্দের ব বর্ণটি বহন (জ্ঞানপ্রবাহকে বহন) এবং ত বর্ণটি তারণ (জ্ঞানপ্রবাহকে প্রবহকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া) ক্রিয়ার ধারক হয়।
সরস্বতীর কচ্ছপীবীণাবাদনরত মূর্ত্তিটি কবি ও শিল্পীদের ভাবনা এবং তাও অসাধারণ। সরস্বতীকে বোঝাতে এর চেয়ে ভাল ভাবনা সহজে মাথায় আসে না। সরস্বতীকে গো, বাণী, বাকদেবী, ভারতী ইত্যাদিও বলে। বেদ-ব্যাকরণ-জ্যোতিষ-গণিত-বিজ্ঞান ইত্যাদি সরস জ্ঞানের চর্চ্চাই আসল সরস্বতী পূজা। এ হল বাণীর সাধনা, বিদ্যার সাধনা। সরস্বতী প্রতিমার পূজা তার একটি প্রতীকী আচরণ মাত্র। আজকের দিনে এহেন প্রতীকী সরবস্বতী পূজার খুব একটা দরকার আছে বলে মনে করি না।
সরস্বতীর বাহন হংস কেন তাও বলি। এর কারণ হংস শব্দের অর্থ হল জ্ঞানী ব্যক্তি, যেমন রামকৃষ্ণ পরমহংস। এরা আত্মজ্ঞান লাভ করে ‘সো অহং’ (‘আমিই তিনি’) বলতে পারেন, তাই এরা হংস। ‘সো অহং’ থেকে ‘হংস’ শব্দটি সৃষ্টি হয়, যেমন হিংসা থেকে শব্দটি থেকে বিপ্রতীপ নিয়মে সিংহ শব্দ আসে। প্রতীকী অর্থে হংস মানে হাঁসও হয়, যে পুকুরে সাঁতার কাটে কিন্তু গায়ে জল লাগায় না। যাইহোক জ্ঞানচর্চ্চাকারী ব্যক্তিরাই সরস্বতীর বাহন বা জ্ঞানপ্রবাহের ধারক।
সরস্বতীকে সারদাও বলা চলে, কারণ এরা সার জ্ঞান দান করে। সরস্বতীর কচ্ছপী বীণা বাদনের তাৎপর্য্যের জন্য এই টাইমলাইনে ‘কচ্ছপী বীণা’ রচনাটি দ্রষ্টব্য।
সরস্বতী পূজার মন্ত্রে আছে ‘কুচযুগ শোভিত মুক্তার হারে’। কোনো কোনো স্বঘোষিত মুক্তমনা ব্যক্তি এতে অশ্লীলতার গন্ধ পান। প্রকৃতপক্ষে এতে লজ্জার কিছু নাই। প্রসঙ্গত, স্ত্রীস্তনে চাপ দিলে তা সঙ্কুচিত হয় বলে তাকে কুচ বলে। কুচ করে কাটা, কুচি দিয়ে শাড়ী পরা, খোলামকুচি, কুচিকুচি ইত্যাদি শব্দের নিরুক্তি বুঝলে কুচ শব্দটিও বোঝা সম্ভব (‘বর্ণসঙ্গীত’ গ্রন্থে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে)। প্রসঙ্গত, কুচভূষণকে অঙ্কও বলে, তা কুচের শোভা বর্ধন করে।কেন কুচভূষণকে অঙ্ক বলে তা এক ভিন্ন প্রশ্ন এবং তার উত্তর এখানে বলা হবে না (‘বর্ণসঙ্গীত’ গ্রন্থে এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন)।
ইরা মানেও সরস্বতী। বাংলা ই বর্ণে গতিময়তা বোঝায়। পঞ্জাবের ইরাবতী একটি বেগবতী নদী। ইরাক, ইরান ইত্যাদি শব্দেও ইরা আছে; সেখানে ইরা মানে জনপ্রবাহ/পণ্যপ্রবাহ বলে ধরা যেতে পারে।
সরস্বতী সম্বন্ধে ভাল করে না জেনে হুজুগে মেতে সরস্বতী পূজা এবং ভক্তিহীন সরস্বতীপূজা করা অর্থহীন। এই নিয়ে একটা গল্প বলছি। বছর দশেক আগে এক সরস্বতী পূজার দিনে আমি একটি কলেজে (কলেজটার নাম উহ্য রইল) জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে একটি সেমিনার করতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ছাত্রছাত্রীদের সেমিনারের দিকে মন নাই, সবাই উসখুস করছে, যেন কোনো তাড়া আছে। তাড়ার কারণটা একটু পরেই বোঝা গেল, যখন ( কিছুক্ষণ পরেই ) দেখলাম ছেলেমেয়েরা হলঘরে ঢুকে সরস্বতীমূর্ত্তির সামনে উদ্দাম নৃত্য শুরু করে দিল। অথচ ওই একই কলেজে আমি তার আগে অন্যান্য বছরে জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে একাধিক আলোচনা করেছিলাম যা ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকশিক্ষিকারা সাগ্রহে শুনেছিলেন, বহু প্রশ্ন করেছিলেন এবং অনেক ছাত্রছাত্রী ভক্তিতে গদগদ হয়ে আমার পায়ের ধূলাও নিয়েছিল (বাধাপ্রদান সত্ত্বেও)। দুইটি দিনের দুই বিসদৃশ চিত্র সেদিন আমাকে অবাক করেছিল, তাই ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকশিক্ষিকাদের এটা জানিয়ে রাখলাম।
পরিশেষে আমার আস্তিক ও নাস্তিক সকল বন্ধুদের বলি যে হিন্দুদেবীদেবীভাবনায় যে যুক্তি ও দর্শনের পরিচয় আছে সেটা ভালভাবে জানা দরকার। আস্তিক ও নাস্তিক সকলের মনে শ্রদ্ধার বিকাশ হোক। জ্ঞানের নদী (সর্বস্বতী) বইতে থাকুক।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন