ফিলিস্তিনীরা নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছে
সাইয়িদ রফিকুল হক
আল্লাহর কিতাব-অনুসারী ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন হলো ইহুদীধর্ম। এদের নবী হজরত মুসা আ.-এর অনুসারীরা সারাবিশ্বে ইহুদী-নামে সুপরিচিত। মুসলমানদের মধ্যে একটি শ্রেণী সবসময় ইহুদীদের গালিগালাজ করে বড় আনন্দ পায়। এরা এই পৃথিবীতে ইহুদীদের জন্য কোনো রাষ্ট্র বা ভূমি ছেড়ে দিতে নারাজ। তাহলে, এরা যাবে কোথায়? এরাও তো আল্লাহর বান্দা? কিন্তু তা সত্ত্বেও আরববিশ্বসহ তৃতীয় বিশ্বের মুসলমানদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হজরত মুসা আ.-র অনুসারীদের সারাক্ষণ গালিগালাজ করে থাকে। এটি তাদের সীমাহীন মূর্খতা। তারা ‘এক আল্লাহ’য় বিশ্বাসী’ ইহুদীদের সর্বক্ষণ গালিগালাজ করে নিজেদের ঈমানবৃদ্ধি করতে চায়! এরা এমনই মূর্খ।
পৃথিবীর আদিমতম (প্রাচীনতম) একটি ধর্মের অনুসারীরা কীভাবে আর কোথায় তাদের মাথাগোঁজার ঠাঁই পাবে? এইবিষয়ে মুসলমানদের একটি শ্রেণী সবসময় নীরব থাকে। আবার কেউ-কেউ বলে থাকে, এদের মেরে ফেলতে হবে! এই হলো এদের ধর্মজ্ঞান! এরা মানুষ কিনা সন্দেহ। এরা পশুরও অধম। পরমতসহিষ্ণুতা বলে এদের মধ্যে কিছু নাই। এরা চরম সাম্প্রদায়িক-অমানুষ।
পৃথিবীতে আল্লাহর নাজিলকৃত চারটি প্রসিদ্ধ কিতাবের একটি হলো তাওরাত। এটি নাজিল হয়েছে আল্লাহর প্রেরিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল হজরত মুসা আ.-এর ওপর। তবুও আরববিশ্বের (তৃতীয় বিশ্বের সহ) অবিবেচক মুসলমানশ্রেণীটি সবসময় ইহুদীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখে তাদের বিতর্কিত চিন্তাভাবনা বাস্তবায়নের অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। এরা ফিলিস্তিনীদের ভুলসমূহ চোখে দেখে না। তারা ইসরাইলরাষ্ট্রের স্বীকৃতি না দিয়ে শুধু ফিলিস্তিন-রাষ্ট্রগঠনের পাঁয়তারা করছে।
আরববিশ্বের ভুলে এবং ফিলিস্তিনীদের নিজের অদূরদর্শিতার কারণে আজও তারা স্বাধীনরাষ্ট্র ঘোষণা করে পরাধীনতার গ্লানি বহন করে চলেছে। ফিলিস্তিনীরা আরবদের কূটচালে বন্দি হয়ে নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে একের-পর-এক ভুল করে আজ ফিলিস্তিনকে নিজেদের রাষ্ট্র ঘোষণা করার পরও তার মালিকানা বুঝে পায়নি।
পৃথিবীতে প্রাচীন জেরুসালেম ও প্যালেস্টাইনকে ঘিরে একটি রাষ্ট্র হতে পারতো। সেখানে ইসরাইলী ও ফিলিস্তিনীরা একসঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করতে পারতো। কিন্তু ফিলিস্তিনীদের একপেশে সিদ্ধান্তের কারণে আরববিশ্বে ইসরাইলী ও ফিলিস্তিনীদের জন্য একটি রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারেনি। তারা কোনোভাবেই ইসরাইলীদের মানুষ ভাবতে ও তাদের ধর্মকে স্বীকার করতে একেবারে নারাজ। ফিলিস্তিনীদের এই একরোখা মনোভাবই তাদের পতনের মূল কারণ।
ফিলিস্তিনীরা নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছে ১৯৪৭ সালে। তখন জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় প্রাচীন জেরুসালেম ও প্যালেস্টাইনকে ঘিরে দুটি রাষ্ট্রগঠনের কথা বলা হয়েছিলো। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এই দুটি রাষ্ট্রগঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিলো—একটি ‘ইসরাইল’ ও অপরটি ‘ফিলিস্তিন’। কিন্তু আমরা জানি, সেইসময় ফিলিস্তিনীরা শুধু নিজেদের রাষ্ট্র চেয়েছিলো, আর ইসরাইল নামক একটি রাষ্ট্রগঠনের ঘোরবিরোধী হয়ে উঠেছিলো। তারা ইসরাইলীদের অস্তিত্ব স্বীকার করতে নারাজ। তাদের গোয়ার্তুমির কারণে তখন জাতিসংঘের অধীনে দুটি রাষ্ট্র গঠিত হতে পারেনি। কিন্তু জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী ইসরাইলীরা সাড়া দিলো। পৃথিবীতে গঠিত হলো ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটি।
১৯৪৭ সালে, জাতিসংঘের কাছে ইসরাইলীরা তাদের রাষ্ট্রের স্বীকৃতি চেয়েছিলো, আর তারা তখন ফিলিস্তিনীদের জন্য পৃথক একটি রাষ্ট্রও মেনে নিতে রাজী ছিল। পৃথক দুটি রাষ্ট্রগঠনের ব্যাপারে তাদের কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু আপত্তি ছিল ফিলিস্তিনীদের। তারা সেই সময় কোনোভাবেই ইসরাইল নামক রাষ্ট্র না-মানার ঘোষণা দিয়েছিলো। তাদের দাবি অগ্রাহ্য হয়েছে। ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটি এখন সর্বত্র স্বীকৃত। কিন্তু ফিলিস্তিনীরা নিজেদের স্বাধীনতাঘোষণা করেও আজ পরাধীনতার গ্লানি বহন করে চলেছে। কারণ, তারা প্রচণ্ড আত্মঅহমিকায় নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মেরে তাদের ভবিষ্যৎ বিনষ্ট করেছে।
ফিলিস্তিনীরা এখনও ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটি ধ্বংস করার ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। তাদের একটি অংশের নষ্টচরিত্রের কারণে পৃথিবীতে ‘হামাস’-এর মতো কুখ্যাত ও নৃশংস সংগঠনের জন্ম হয়েছে। প্রথমদিকে ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতার জন্য ছিল শুধু পি.এল.ও. (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন)। এর নেতৃত্বে ছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন নেতা ইয়াসির আরাফাত। তখনও পর্যন্ত এরা শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের ভূখণ্ডের জন্য আন্দোলন করছিলো। কিন্তু যেই তাদের মধ্যে থেকে জন্ম হলো কুখ্যাত হামাসের। তখনই শুরু হলো মানুষ আর মানবতার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী অপকাণ্ড। আজ আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই পৃথিবীতে চারটি সংগঠন সর্বাপেক্ষা কুখ্যাত ও নৃশংস। এই চারটি সংগঠনের নাম হচ্ছে—
১. মিশরের ‘ব্রাদার হুড বা ইখওয়ানুল মুসলিমীন’;
২. ফিলিস্তিনের ‘হামাস’;
৩. পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়্যেবা; আর
৪. বাংলাদেশের ‘ইসলামীছাত্রশিবির’।
এদের কাজই হচ্ছে মানুষ আর মানবতার বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালানো। আর এমন একটি অপসংগঠন হামাসকে বগলদাবা করে ফিলিস্তিনীরা কখনও নিজেদের কাঙ্ক্ষিত সফলতালাভ করতে পারবে না। তার কারণ, ফিলিস্তিনীদের অবস্থা এখন ‘মুখে শেখ ফরিদ বগল মে ইট’! আর তাই, সন্ত্রাস আর শান্তিপূর্ণ আলোচনা কখনও একসঙ্গে চলতে পারে না।
ইয়াসির আরাফাত পর্যন্ত তবুও কিছুটা অগ্রগতি অর্জিত হয়েছিলো। কিন্তু তাঁকে হত্যা করে মাহমুদ আব্বাসগং কিছুই করতে পারেনি। তারা এখনও তাদের অন্যায্য দাবির প্রতি অনড় ও অটল। তাদের এই অন্যায্য দাবি দুটি হচ্ছে—শুধু ফিলিস্তিন নামক একটি রাষ্ট্র হবে! আর ফিলিস্তিনের রাজধানী হবে জেরুসালেম! কিন্তু কেন? তারা কেন বলে না—পৃথিবীতে দুটি রাষ্ট্র হোক—একটি ইসরাইল অপরটি ফিলিস্তিন। আর জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করতে ফিলিস্তিনীদের বাধা কোথায়? আজ পৃথিবীর প্রায় সবাই জানে, জেরুসালেম ইহুদীদের, এবং তা একমাত্র তাদের ৪০০০-৫০০০ বছরের প্রাচীন নগরী ও ধর্মকেন্দ্র। জেরুসালেমের ‘মসজিদুল আকসা’ বা ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ তো ইহুদীদের। এখন এ-কে ঘিরে তাদের রাজধানী হতে বাধা কোথায়?
মুসলমানদের জন্য রয়েছে পবিত্র মক্কা। তা সত্ত্বেও মুসলমান-নামধারী ফিলিস্তিনীরা জেরুসালেমের জন্য এতো উন্মাদ কেন? কেন এতো ধর্মীয় আধিপত্যবিস্তারের নীলনকশা? কেন?
ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটি ধ্বংস করার জন্য ফিলিস্তিনীরা আরবদের যোগসাজশে সেই ১৯৪৮ সাল থেকে এ-পর্যন্ত ইসরাইলীদের সঙ্গে তিন-তিনবার যুদ্ধ করেছে! কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আর কোনো যুদ্ধেই আরবরা সুবিধা করতে পারেনি। বরং এতে সবসময় সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল ইসরাইল। আমরা, যুদ্ধ নয় শান্তি চাই। আর পৃথিবীতে শান্তি বজায় রাখার স্বার্থেই ফিলিস্তিনীদের এখন ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের রাষ্ট্রের স্বীকৃতিআদায় করে নিতে হবে। অন্যথায়, সংঘাতসৃষ্টি করে কোনো লাভ হবে না।
এখন যদি ফিলিস্তিনীরা জেরুসালেমের আশায় বেশি বাড়াবাড়ি করে তবে পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে বাধ্য। কিন্তু তবুও ফিলিস্তিনীরা কখনও জেরুসালেম দখল করতে পারবে না। পৃথিবীর ইতিহাস আজ তা-ই বলে।
ফিলিস্তিনীদের এখনই জেরুসালেমের দাবি ছেড়ে দিতে হবে। আর ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের ফিলিস্তিনকে পুরাপুরি স্বাধীন করে নেওয়া উচিত। এটিই সময়ের দাবি। অন্যথায়, সাধারণ এক জেরুসালেমের জন্য পৃথিবীতে অশান্তির বীজবপন করা উচিত নয়। এমনকি এই নিয়ে মানুষ আর মানবতার বিরুদ্ধে অনাকাঙ্ক্ষিত ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে’র দামামা বাজানোও মনুষ্যত্বের কোনো পরিচয় নয়।
সম্প্রতি পোপ ফ্রান্সিস ফিলিস্তিন-সমস্যা সমাধানের জন্য দুটি রাষ্ট্রগঠনের সুন্দর একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। তাঁর এই প্রস্তাব ফিলিস্তিনীদের মেনে নেওয়া উচিত। নইলে, ১৯৪৭ সালের মতো তাদের আবারও খেসারত দিতে হবে। তাদের একপেশে সিদ্ধান্ত ও স্বপ্ন কখনও বাস্তবায়িত হবে না। মনে রাখতে হবে, আল্লাহ শুধু ফিলিস্তিনীদের একার নয়—তিনি সবার। হজরত মুসা আ.-এর অনুসারীরাও আল্লাহকে ডাকেন। অতএব, তাদের প্রতি সম্মান রেখেই ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হতে হবে। আর আমাদের-মুসলমানদের ন্যায্য ছাড় দেওয়ার মানসিকতাও রাখতে হবে।
কথায় আছে: হাতের লক্ষ্মী কখনও পায়ে ঠেলতে নাই। আর ১৯৪৭ সালে, ফিলিস্তিনীরা সেই ভুল করেছিলো। তারা নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছিলো। এখন তাদের সামনে শান্তির দূত হয়ে এগিয়ে এসেছেন পোপ ফ্রান্সিস। নিজেদের ও বিশ্বশান্তির স্বার্থে ফিলিস্তিনীদের আজ এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে আলোচনায় বসা উচিত। আর স্বাধীন ফিলিস্তিনের পাশে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটির স্বীকৃতি দিতে ফিলিস্তিনীদের মনে এতো বাধা কীসের? আর কীসের এতো কার্পণ্য?
ফিলিস্তিনীরা আর কত এভাবে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারবে?
সাইয়িদ রফিকুল হক
২৯/১২/২০১৭