১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে মীরজাফররা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো সেই তারাই ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামানকে হত্যা করে। আমি তাদের সকলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
এই মূহুর্তে আমার মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, শেখ রাসেল এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সংগে জড়িত আমার কিছু আবেগমাখা স্মৃতির কথা।
সেই স্মৃতিগুলি বর্ণনা করতে হলে তার আগে আমাকে স্মরণ করতেই হবে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার মরহুম এমপি আব্দুল জব্বারের কথা।
আমার বাড়ি সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া। আমি যখন কুলাউড়া নবীন চন্দ্র হাই স্কুলে ক্লাশ সিক্সে ভর্তি হয়েছিলাম (১৯৬০) তখন জব্বারভাই ক্লাশ এইটের ছাত্র এবং ছাত্র লীগের নেতা। আমি স্কুলে থাকাকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম, কাজেই হাই স্কুলে ঢুকেই ছাত্র ইউনিয়নের সাথে পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছিলাম। ২/৩ বছরের মধ্যেই আমি সংগঠন সম্পর্কে বেশ পোক্ত হয়ে উঠলাম এবং জব্বার ভাইদের সাথে সুন্দর সহাবস্থানমূলক সম্পর্ক স্থাপিত হলো। কিন্তু আমি যখন নবম শ্রেণীর পরীক্ষা সমাপন করলাম সেই সময় ছাত্রলীগ ও ছাত্রইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্কের বেশ খানিকটা ফাটল ধরলো। ছাত্র ইউনিয়নে আমার জনপ্রিয়তার কারণে ছাত্র লীগ আমার বিরুদ্ধে এক চক্রান্ত তৈরী করলো যাতে আমি আর স্কুলেই থাকতে না পারি। কিন্তু আমি জানতাম জব্বারভাই ঐ চক্রান্তে সমর্থন দেননি। তিনি আমাকে নিতান্তই স্নেহের চোখে দেখতেন। এই চক্রান্তে আমি বাধ্য হয়েছিলাম কুলাউড়া ত্যাগ করে অন্যত্র পড়ালেখা করতে চলে যেতে।
এরপর ধাপে ধাপে আমি মৌলভীবাজারের মুনশীবাজার কালীপ্রসাদ হাই স্কুল থেকে মেট্রিক এবং মৌলভীবাজার কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ১৯৭২ সালে ঢাকা থেকে বিএ পাশ করি। সে সময় আমি বেকারত্বের যন্ত্রণায় ছিলাম। তবে খানিকটা হেল্প হচ্ছিলো সাপ্তাহিক বিচিত্রায় (বিচিত্রার প্রথম ৬ মাস)প্রুফ সেকশনে চাকুরী করে। সেই অবস্থায় জুন মাসে করেছিলেম বিয়ে। কিন্তু বিচিত্রার সামান্য বেতনে পরিবার নিয়ে সংসার চালানোর কোনোই উপায় ছিলোনা বিধায় চলে গেলাম কুলাউড়ায়। ১৯৭৩ সালে আমি যখন কুলাউড়ায় বসবাস শুরু করি তখন আব্দুল জব্বার আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা। আমার বাবা আজম বোর্ডিং-এর মালিক মোবারক আলী (মরহুম)তখন সর্বজন পরিচিত আওয়ামী লীগ নেতা। আজম বোর্ডিং-এ ছিলো জব্বারভাইয়ের প্রধান আড্ডা। যেভাবেই হোক অবস্থার প্রেক্ষিতে জব্বারভাই এবং আমার বাবা মিলে আমাকে আওয়ামী লীগে যুক্ত করাতে চাইলেন। আমাকে তা মেনে নিতেই হলো! সিদ্ধান্ত হলো কয়েকদিনের মধ্যেই রেল-মন্ত্রী ক্যাপটেন মনসুর আলী কুলাউড়ায় আসবেন ভাটেরাবাজার রেল-স্টেশন উদ্বোধন করতে। তখন কুলাউড়াতে একটি জনসভা করা হবে। সেই জনসভায় আমাকে আওয়ামী লীগে যোগদান করানো হবে আনুষ্ঠানিকভাবে।
আমি তখন মোটামুটি পেশাদার সাংবাদিক। ক্যামেরা নিয়ে সংবাদ সংগ্রহে ছুটোছুটি করে বেড়াতাম। বৌ নিয়ে বাপের হোটেলে খেতাম।
নির্ধারিত দিনে, সম্ভভবত ১৯৭৩ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে মনসুরভাই আসলেন। ভাটেরাবাজারে আমি তার সঙ্গে রেল-স্টেশন উদ্বোধনে গেলাম ক্যামেরা নিয়ে। সেই ছবিসহ সংবাদটির পেপার কাটিং আছে এখনো আমার কাছে।
পরদিন কুলাউড়ায় জনসভা এবং সেখান থেকে বড়লেখায় গিয়ে ডাকবাংলোতে লাঞ্চ সেরে বড়লেখায় জনসভা—যতদূর মনে পড়ে অনুষ্ঠানসূচী ছিলো এরকমের কিছু। কুলাউড়ার জনসভায় আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের সদস্য ঘোষনার পর আমাকে বক্তৃতা দিতে হয়েছিলো। যতদূর মনে পড়ে আমি সেই বক্তব্যে ইতোপূর্বে হয়ে যাওয়া সাধারণ নির্বাচনে কুমিল্লায় ন্যাপ নেতা মোজাফফর আহমেদের কুড়ে ঘরের সোচনীয় পরাজয় এবং ফলাফল ঘোষনার অব্যাবহিতকাল পর জনসভায় তার ভাষনে জনতার রায়কে মেনে নেওয়ার উপর একটি মন্তব্য করেছিলাম, যার ফলে করতালিতে উচ্ছকিত হয়ে উঠেছিলো সভাস্থল।
পরে বড়লেখা গিয়ে যখন মনসুর ভাই লাঞ্চের টেবিলে বসে খাবার শুরু করতে যাবেন ঠিক সেই মুহুর্তে তাঁর মনে পড়ে গেলো আমার কথা। বললেন
-ঐ ছেলেটি কই, যে কুলাউড়াতে বক্তৃতা করেছিলো?
জব্বারভাই বললেন
-আপনি কি কবিরের কথা বলছেন মনসুরভাই, যে লীগে যোগ দিয়েছে?
মনসুরভাই সহাস্যে বলে উঠলেন
-আরে হ্যা হ্যা কবির, কবিরকে ডাকো।
আর যায় কই! মন্ত্রী বলেছেন! পাত্র মিত্র পারিষদ খোঁজাখুঁজিতে লেগে গেলেন-কবির কোথায়! আমি আসলে তখন পাশের কক্ষেই ছিলাম। খুব সম্ভবত আমারই সহপাটি এবং পড়শী, আবার জব্বারভাইয়েরও সহপাটি আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান আতা আমাকে একরকম ধরেই নিয়ে গিয়ে বললো
-মনসুরভাই, এইতো কবির!
মনসুরভাই খুব খুশী হয়ে বললেন
-আরে কবির! তুমি কোথায় ছিলে? বস বস। এই প্লেট লাগাও।
এইভাবেই আমি খুব অল্প সময়ে মনসুরভাইয়ের প্রিয় হয়ে গেলাম। আর তার এই স্নেহের সূত্র ধরে আমি কেমন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্নেহাষ্পর্শ পেয়েছিলাম তা বলবো ধারাবাহিকভাবে।
ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী পরদিন যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন রেল স্টেশনে নেতারা সবাই তাকে বিদায় জানাতে যান, আমিও ছিলাম সকলের সাথে। আমি একফাঁকে জব্বার ভাইকে বললাম যেনো তিনি আমার জন্য মনসুর ভাইকে একটি চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিতে বলেন। জব্বার ভাই খুব সহজেই আমার এই প্রস্তাবে রাজী হলেন, কারন তিনি আমার কষ্টের কথা বিশদভাবে জানতেন।
কুলাউড়া স্টেশন প্লেটফার্মে সেদিন যে ট্রেনটিতে মনসুর ভাইয়ের জন্য যুক্ত করা ভিয়াইপি সেলুনে তিনি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন সেই ট্রেনটির নাম আজ আর মনে নেই। তবে আমি বিদায় নিচ্ছিলাম সকল শেষে, তখন জব্বার ভাই মনসুর ভাইকে বললেন
– মনসুর ভাই, কবিরের একটা চাকুরী দরকার।
মনসুর ভাই অবাক দৃষ্টিতে খানিকটা আহত মনেই আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মূহুর্ত। পরে বললেন
– তুমি চাকরী করবে? তাহলে পার্টি…!
জব্বার ভাই সাথে সাথেই বললেন
-কবির বিবাহিত এবং এক সন্তানের বাপ। সে অসুবিধায় আছে–
মনসুর ভাই এবার দ্বিগুণ অবাক হয়ে বললেন
– তাই নাকি! ঠিক আছে, তুমি ঢাকায় গিয়ে আমার সংগে দেখা করবে। টেনশন করনা, চলে এসো।
জব্বার ভাই ও আমি নেমে গেলাম বিদায় নিয়ে, ট্রেন ছেড়ে দিলো।
জব্বার ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
– তোর চাকরিতো হয়ে গেলো। যা ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নে এবং তাড়াতাড়ি ঢাকা যাওয়ার
ব্যবস্থা কর।
খুব তাড়াতাড়ি আমি ঢাকা গেলাম। সচিবালয়ে গিয়ে যোগাযোগ করে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর কক্ষের এক প্রান্তের একটি দরজা দিয়ে যখন ভেতরে প্রবেশ করলাম তখন কক্ষের অন্য প্রান্তে দেখলাম মনসুর ভাই দাড়িয়ে গেলেন। বললেন
– আরে নেতা আসো আসো।
আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম আর লক্ষ্য করছিলাম মনসুর ভাইয়ের সামনে পাত্র মিত্র পারিষদ যারা ছিলেন সবাই দাড়িয়ে যেনো আমাকেই অভ্যর্থনা করছিলেন। বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশ থেকে তিনি বলতে থাকলেন
– আমার কুলাউড়ার নেতা গোলাম কবির
পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন আমাকে! আমি কাছে আসতেই বললেন
– বসো বসো
বলেই তিনি বসলেন, আমি বসলাম তারপর বসলেন অন্য সবাই! লেবু রসের চা এবং বিস্কুট দিয়ে গেলো পিয়ন। মনসুর ভাই বললেন
– চা খাও। তারপর বলো কি খবর কুলাউড়ার, সবাই ভালো?
– জ্বি মনসুর ভাই, ভালো।
তিনি আমার সংগে একটু কথা বলেই সামনে অপেক্ষমান অফিসারদের সংগে কাজের কথা সেরে নিলেন। পরে আমাকে বললেন
– হ্যা, তোমার একটা চাকরী দরকার।
এই বলে তিনি ড্রয়ার থেকে একটা সাদা কাগজ দিয়ে আমাকে একটা দরখাস্ত লিখতে বললেন। আমি অনেকটা বোকার মতো জিজ্ঞেস করলাম
– কি লিখবো মমসুর ভাই?
তিনি বললেন
– লিখ, আমি একজন বিএ পাশ বেকার যুবক। আমার একটা চাকরীর দরকার—
তাই লিখলাম আমি। অর্থাৎ চাকরীর দরখাস্ত। দিলাম তাঁর হাতে। তিনি সেটা তার সামনে নিয়ে টেবিলে স্থাপন করে বামপাশে ইংরেজীতে লিখলেন ” হি ইজ এ কম্পিটেন্ট পারসন, প্লিজ একোমেড হিম ইন এ সুইটেবোল জব”। তারপর ওটা আমার হাতে দিলেন এবং রিসিভার হাতে নিয়ে রিং করলেন একজন সেকশন অফিসারকে। বললেন
– নবী সাহেব, আমি গোলাম কবির নামে একজনকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। দেখেন তার জন্য কি করা যায়।
এরপর আমাকে বললেন সেকশন অফিসার নুর নবীর সংগে তখনই গিয়ে দেখা করতে। যতদূর মনে পড়ে তখন তথ্য মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বও ছিলো মনসুর ভাইয়ের উপর। নূর নবী ছিলেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের রিসার্চ এন্ড রিভিউ বিভাগের সেকশন অফিসার। আমি মনসুর ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেলাম নূর নবীর চেম্বারে।
সেকশন অফিসার নূর নবীর চেম্বারে ঢুকতেই বুঝতে পেরেছিলাম মনসুর ভাই আমার সম্পর্কে উনাকে ভালোই ধারনা দিয়েছিলেন যে আমি মোটামুটি হেলাফেলার মানুষ না! আমাকে যথেস্ট সমাদরপূর্বক জানিয়ে দিলেন সেগুন বাগীচায় আর এন্ড আর-এর মূল অফিসে চলে যেতে, যেখানে নবী সাহেব ইতোমধ্যেই আমার বিষয়ে জানিয়ে রেখেছেন। কিন্তু আমার কৌতুহল কেবলি বাড়ছিলো। কি ধরনের চাকরী হতে পারে এটি। কৌতুহল দমন করে না রেখে নূরনবী সাহেবকেই প্রশ্ন করলাম
-আচ্ছা নবী ভাই, চাকরীটা কি? পদবী কি?
নবী সাহেব বললেন
-রিসার্চ অফিসার। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘আর এন্ড আর’ (রিসার্চ এন্ড রিভিউ)-এর একটা সেকেন্ডক্লাশ গ্যাজেটেড অফিসারের পোস্ট। আপনি ওখানে গেলে হেডক্লার্ক আপনাকে সব বুঝিয়ে দেবেন।
-ওকে। তাহলে আমি উঠি নবী ভাই।
সচিবালয় থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলাম সেগুনবাগীচায়। এখন আর মনেও পড়ছেনা কোন জায়গায় ছিলো সেই দপ্তরটি। তবে আবছা আবছা যতটুকু মনে পড়ে একটা টিনসেড ভবনের একটি কক্ষে গিয়ে যখন আমি সেই দাড়িওয়ালা বয়োস্ক হেডক্লার্ককে (এখন নাম মনে নেই) আমার পরিচয় দিতে যাচ্ছিলাম তখন তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন
-থাক স্যার, আর বলতে হবেনা, আমি জানি আপনি গোলাম কবির সাহেব, সেকশন অফিসার নবী স্যার আপনারে পাঠাইছেন। আপনি ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী স্যারের লোক। বসুন স্যার, বসুন।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো কেরাণী সাহেবের মুখের দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থেকেই বসে পড়লাম তার সামনের একটি চেয়ারে। কেরাণী সাহেব পিয়নকে নির্দেশ দিলেন চা নাস্তা আনার জন্য। আমি বললাম
-দেখুন ভাইজান, চা টা খেতে হবেনা। আপনি আমাকে এপোয়েন্টমেন্ট লেটারটা দেন দয়া করে।
তিনি আমাকে বললেন
-সব হবে স্যার। ব্যস্ততার কিছু নেই। আপনার চাকরীতো হয়েই গেছে। এখন শুধু কাগজপত্রের কাজগুলো সারতে যেইটুকু সময়। তবে আপনিতো সিলেট থেকে এসেছেন। আজকেই চলে যান। সপ্তাহখানেক পর চলে আসবেন। আমি এর মধ্যে সব ঠিকঠাক করে রাখবো। এখন কেবল আমি আপনার কিছু ডিটেইলস জেনে নেবো। তারপরই আপনি ফ্রি।
আমার ডিটেইলস, সার্টিফিকেট ইত্যাদি দিয়ে চলে গিয়েছিলাম কুলাউড়া। কিন্তু আমি এক সপ্তাহ পর কেনো যেনো ঢাকায় যেতে পারিনি। গিয়েছিলাম দু’সপ্তাহ পর। কেরানী সাহেবের সামনে যখন গেলাম তখন তিনি এমনভাবে বললেন যেনো আমি কোনো অঘটন ঘটিয়ে এসেছি
-আপনি এসেছেন! আহহা, আর ২ টা দিন আগেও যদি আসতেন!
-আমি একটু উদ্বিগ্ন হলাম
-কেনো ভাইজান, কি হয়েছে?
আমার উদ্বিগ্নতা দেখে কেরানী সাহেব একটু যেনো থতমত খেলেন মনে হয়েছিলো। বললেন
-বসুন স্যার, বসুন।
আমি বসতেই তিনি পিয়নকে চা দিতে বললেন। আমি খানিকটা বিরক্ত হয়েই বললাম
-না না, চা খাবোনা, আমার এপোয়েন্টমেন্ট লেটার দিয়ে দেন এবং কি করতে হবে বলেন।
কেরানী সাহেবকে তখন আরেকটু ভাবিত হতে দেখলাম! চা এলো এবং চায়ে চুমুক দিয়েই বললাম
-আচ্ছা বলুনতো, কোনো অসুবিধা হয়েছে?
কেরাণী সাহেব প্রায় ঢোক গেলার মতো করেই আমতা আমতা বললেন
-না, মানে—ইয়ে, মানে প্রাইম মিনিস্টারের একটা স্টেন্ডিং ওর্ডার আছে যে, পাকিস্তান থেকে যে সব অফিসাররা আসবেন যেনো তারা আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের যোগ্য শুন্য পোস্টগুলোতে তাদের আপয়েন্টমেন্ট দিয়ে দেওয়া হয়। এইতো ৪/৫ দিন আগে একটি দল এলেন, তাদের মধ্যে এই পোস্টের একজন ছিলেন। আর পোস্টও একটাই যেটার এগেইনস্টে আপনার জন্য এপোয়েন্টমেন্ট লেটার ইস্যু হয়ে গিয়েছিলো। এই দুদিন আগেই সেটা কেন্সেল করে উনার নামে পরিবর্তীত করা হলো।
কেরাণী সাহেবের কথা শুনতে শুনতে আমার মেজাজ একেবারেই বিগড়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো ওরা পাকিস্তানে নিরাপদে থেকে স্বাধীন দেশে এসেই স্বাধীনতার ফসল পেয়ে যাচ্ছে, আর আমরা ৯ মাস লাঞ্ছিত হয়ে মৃত্যুর গহ্বর থেকে বেঁচে এসে পুনরায় অনিশ্চয়তার গহ্বরে পতিত হচ্ছি। কেরাণী সাহেব বোধ করি বুঝতে পেরেছিলেন আমার মনের অবস্থা। বললেন
-স্যার আপনারতো অসুবিধা নেই। আবার গিয়ে ক্যাপ্টেন স্যারকে বলেন, আরেকটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
ক্রোধ সংবরণ করে আমার সার্টিফিকেট ইত্যাদির ফাইলটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম পথে। মাথার উপর উত্তপ্ত সূর্য্য। কোথায় যাবো। কি করবো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলামনা।
অনির্দিষ্ট গন্তব্য। হাটছিলাম আর ভাবছিলাম, বাবার ইচ্ছেতেই আওয়ামি লিগে যোগদান করে যা হোক একটা সুযোগ জুটলো যদিও তাও প্যাঁচে পড়ে গেল? এখন আবার ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সাথে দেখা করাতো চাট্টিখানি কথা নয়! ঠিক সেই সময় মাথায় এসে গেলো কুলাউড়ার তখনকার এমপি নওয়াবজাদা আলী সারাওয়ার খান ওরফে চুন্নু নওয়াবের কথা। জানতাম তিনি ধানমন্ডি থাকতেন। সোজা চলে গেলাম তার বাসায়। তিনি তখন দলিয় লোকজনের সাথে আলোচমায় ছিলেন। আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। বললেন
– আরে আমার কুলাউড়ার নেতা যে! কি খবর। কেমন আছ?
আমি বললাম- বিপদে আছি। মনসুর ভাই একটা চাকুরী দিয়েছিলেন কিন্তু পাকিস্তান থেকে একজন এসে সেটা নিয়ে নিয়েছেন।
শুনে চুন্নু নওয়াব একটু ভাবিত হলেন। তাইতো, কী কিরা যায় তবে?
আমি বললাম, এখুনি চলেন আমাকে নিয়ে মনসুর ভাইয়ের অফিসে। তিনি রাজি হলেন। সবাইকে বিদায় কিরে দিলেন। আর সোফারকে হাঁকলেন গাড়ি বের করতে।
ক্যাপ্টেন মনসুর আলী তখন সংসদ ভবনের তাঁর কার্যালয়ে ছিলেন। তাই আমাদেরকে যেতে হয়েছিল তেজগাঁয়ের সেই পুরনো সংসদ ভবনে। এমপি নওয়াব আলী সারোয়ার ওরফে চুন্নু নওয়াবের পেছনে পেছনে আমি সংসদ ভবনের কার্যালয়ে যখন ঢুকলাম তখন অপেক্ষা করছিল আমার জীবনের উজ্জ্বল মূহুর্তটি। যে কক্ষে প্রবেশ করলাম প্রথমে সেটা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কক্ষ। নওয়াব সাহেবকে দেখেই বঙ্গবন্ধু সোৎসাহে বলে উঠলেন- আরে নবাব সাহেব! কি খবর!
নবাব বললেন- জ্বি ভালো আছি। ঠিক সেই সময় বঙ্গবন্ধুর চোখ পড়লো আমার উপর। নবাব বুঝতে পারলেন এবং বললেন- আমাদের কুলাউড়ার নেতা গোলাম কবির। কবি এবং সাংবাদিক।
আমি তখন এতোটা আভিভুত হয়ে পিড়েছিলাম যে নিজের অজান্তেই নুয়ে পড়লাম বঙ্গবন্ধুর করকমলে। তিনি স্বভাবসুলুভ তাঁর ডান হাত মুছে দিলেন আমার পিঠের উপর এবং বললেন- আমিতো তোরে চিনি।
আমি অবাক বিস্ময়ে মাথা উঠিয়ে চেয়ে রইলেম যেনো এক ফুটন্ত গোলাপের পানে। আর তিনি বলে চলছিলেন- তুই হকার্স লিগ থেকে আমার গলায় মালা পরিয়েছিলি!
কী অসাধারণ স্মরণশক্তি ছিলো তাঁর। আমি বিস্ময়াবিভুত হয়ে নিজেও খুঁজে পাচ্ছিলেমনা, কবে কোনদিন দিয়েছিলাম তাঁর গলায় মালা!
নওয়াব বললেন- কবিরকে ক্যাপ্টেন সাহেবের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।
তিনি বললেন- যান, যান। নিয়ে যান।
আমাকে নিয়ে নওয়াব যখন ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর কক্ষে ঢুকলেন তখন মনসুর আলী পাত্র মিত্র পারিষদ নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু আমাদের দু’জনকে দেখে একরকম হৈচৈ করে উঠলেন।
নওয়াব সাহেব বললেন- নেতাকে নিয়ে আসলাম আপনার কাছে। তার চাকরীটা হয়নি। এই বলে আমাকে রেখে গেলেন অন্য কোথাও। আমি মনসুর ভাইয়ের টেবিলের সামনে একটা চেয়ারে বসলাম। তিনি আমার সাথে প্রথমত একটু রসিকতা করতে চাইলেন। বললেন- চাকরিটা হয়নি, নাকি আরেকটা বাগাতে এসেছো!
আমি খুবই অসম্মান অনুভব করলাম।
-তাহলে আমি চললাম
বলেই আমি বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন মনসুর ভাই চিৎকার করে উঠলেন- সেন্ট্রি, ওকে আটকাও।
সেন্ট্রি আমাকে আগলা দিয়ে বলছিলেন- স্যার স্যার প্লিজ থামুন—।
ফিরে এলাম এবং বসলাম আগের জায়গায়। মনসুর ভাই হাসতে হাসতেই বলেছিলেন- এতো রাগ তোমার! এই, কবিরকে চা দেও, বিস্কুট দেও।
যাই হোক, ইতোমধ্যেই তিনি নুর নবীর কাছ থেকে জেনে নিয়েছেন সেই চাকুরীর বৃত্তান্ত। তারপর বললেন- কি চাকরি যে দেই তোমাকে—! আমি তখন তাঁকে বিব্রত হওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যেই হয়তো বলেছিলাম- মনসুর ভাই, আপনার ডিপার্টমেন্টেই একটা কিছু দিয়ে দেন।
একথা শুনে তিনি বললেন- যাহ, আমার ডিপার্টমেন্ট, মানে রেলওয়েতে! ওখানে তুমি কি করবে?
আমি বললাম- দিয়ে দেন টিটি, টিসি মিসি একটা কিছু। পরে বদলানো যাবে, আপনিতো আছেনই।
মনসুর ভাই পলকহীন তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম। মূহুর্ত পরেই আমার দিকে একটা সাদা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন- তবে আর কি করা। লেখ।
আগের মতোই লিখলাম। তিনিও সুপারিশ লিখিলেন নিচে বাঁয়ে। বললেন- চলে যাও রেল ভবনে। বাকিটা আমি বলে দেবো। কিন্তু মনে রেখো, এবার যেনো কুলাউড়ায় গিয়ে বসে থেকোনা।
ঐ চাকুরি আমার হয়েছিল। কিন্তু চাকুরিতে যোগদান পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ঘটে গিয়েছিল আমার জীবনের আরেকটি দুর্ঘটনা। যে কারনে দীর্ঘ প্রায় ৫/৬ মাস পর আমি যোগ দিয়েছিলাম রেলওয়ের চাকুরিতে। আর তার কিছুদিন পর হারালাম বঙ্গবন্ধুকে এবং দুই মাস পর আমার এতো প্রিয় ক্যাপ্টেন মনসুর ভাইকে।
চুয়াল্লিশ বছর পর আজও মনে পড়ে আমার সেইসব স্মৃতি। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর স্মৃতি, মরহুম এমপি আব্দুল জব্বারের স্মৃতি।
লন্ডন, নভেম্বর ২০১৭